দুই কারাগারে গচ্চা ২৫০ কোটি টাকা

প্রকাশিতঃ জুলাই ৭, ২০২৪ | ৮:৫১ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেক্স

সম্ভাব্যতা সমীক্ষা না করেই অনুমানের ওপর নির্ভর করে নেওয়া হয়েছে দুই কারাগার নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ প্রকল্প। তাই এটা বাস্তবায়ন পর্যায়ে ঘটে বিপত্তি। বারবার বেড়েছে এর মেয়াদ ও ব্যয়। তবুও এর কাজ শেষ হচ্ছে না। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে ২৫৬ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। এই অর্থ ব্যয় করেও প্রকল্প শেষ হবে কি না তা নিয়েও দেখা দিয়েছে শঙ্কা। প্রকল্প দুটির মধ্যে ‘খুলনা জেলা কারাগার নির্মাণ’ করতে পাঁচ বছরের সময় গড়িয়েছে ১৩ বছরে। আর ‘ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কারাগার পুনর্নির্মাণে’ সময় বেড়েছে ২৩৩ দশমিক ৩৩ এবং ব্যয় বেড়েছে ৮৮ দশমিক ২০ শতাংশ। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নিবিড় পরিবীক্ষণ সমীক্ষায় উঠে এসেছে এসব ভয়াবহ তথ্য। প্রকল্প দুটির প্রাথমিক ব্যয় ছিল ২৭২ কোটি ৮ লাখ টাকা। পরে ২৫৬ কোটি ৩৩ লাখ টাকা বেড়ে এর বর্তমান ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৫২৮ কোটি ৪১ লাখ টাকা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতায় এগুলো বাস্তবায়ন করছে কারা অধিদপ্তর এবং গণপূর্ত অধিদপ্তর। ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তফা কে. মুজেরী শনিবার বলেন, প্রকল্পের আবশ্যিক যে কাজটি করার কথা (সম্ভাব্যতা সমীক্ষা) সেটি না করে অবহেলা করায় এখন তা গলার কাঁটা হয়ে গেছে। এজন্য শুধু যে শত শত কোটি টাকা গচ্চা যাচ্ছে তা নয়, সময়ও গচ্চা যাচ্ছে। পাশাপাশি উন্নয়ন কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে। মানুষ একবার ভুল করতে পারে। কিন্তু বারবার বিভিন্ন প্রকল্পে একই ধরনের ভুল হচ্ছে। এ রকম ইচ্ছাকৃত ভুলের চড়া মাশুল দিচ্ছে জনগণ। আইএমইডির সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, একে সরাসরি আমরা গচ্চা বলতে চাচ্ছি না। এ ঘটনাকে পরিকল্পনার ত্রুটি বলা যায়। কেননা যদি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা হতো তাহলে বোঝা যেত কোথায় কোথায় সমস্যা আছে। কত টাকা ব্যয় হবে, বাস্তবায়নে কতদিন সময় লাগবে। তাহলে হয়তো বাস্তবায়ন পর্যায়ে গিয়ে এমন অবস্থা হতো না। অধিকাংশ প্রকল্পে যে জমি অধিগ্রহণসংক্রান্ত জটিলতা হয়, সেটিও থাকত না যদি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ঠিকমতো করা হয়। তিনি আরও বলেন, অনুমাননির্ভর প্রকল্প তৈরি করে দ্রুত অনুমোদন করিয়ে নেওয়ার প্রবণতা থেকে এ রকম ঘটনা ঘটে। এগুলো প্রত্যাশিত নয়। আইএমইডির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, খুলনা জেলা কারাগার নির্মাণ প্রকল্পের শুরুতে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়নি। ফলে বারবার মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানের পর এখনো বাস্তবায়ন অনিশ্চিত। এ প্রকল্পের মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল ১৪৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। পরে দফায় দফায় সংশোধনের মাধ্যমে ব্যয় ১৪৩ কোটি ৭৪ লাখ টাকা বাড়িয়ে ২৮৮ কোটি ২৬ লাখ টাকা করা হয়। শুধু তাই নয়, দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে মেয়াদও। এক্ষেত্রে মূল অনুমোদিত মেয়াদ ছিল ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত, পাঁচ বছর। কিন্তু বিভিন্ন সময় মেয়াদ বাড়িয়ে করা হয় ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। কিন্তু এখনো প্রকল্পের অনেক কাজই বাকি। গত মার্চ মাস পর্যন্ত প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৯১ শতাংশ এবং ব্যয় হয়েছে ২২৬ কোটি ৮৮ লাখ টাকা অর্থাৎ আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৭৯ শতাংশ। কিন্তু এখনো বৃষ্টির পানি সংরক্ষণাগার, সৌরবিদ্যুৎ, বনায়ন, পানির রিজার্ভার, ফাঁসির মঞ্চ এবং একটি অতিরিক্ত পাম্প হাউজের নির্মাণকাজের অগ্রগতি শূন্য রয়েছে। আইএমইডি বলছে, প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা না হওয়ায় ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) তৈরিতে পূর্ত কাজের প্যাকেজসহ বিভিন্ন অঙ্গ সংস্থানে কিছুটা অসামঞ্জস্যতা ছিল। এছাড়া আগেই জমি নির্ধারিত না থাকায় ভূমি নির্বাচন করতে অত্যধিক সময় লেগেছে। প্রকল্পের ডিপিপিতে ভূমি অধিগ্রহণে পর্যাপ্ত বরাদ্দ না ধরায় ভূমি উন্নয়ন ও ভূমি অধিগ্রহণ সম্ভব হয়নি। পাশাপাশি সঠিক সময়ে প্রকল্পের যাবতীয় নকশা তৈরি করা হয়নি। আবার বাস্তবায়ন পর্যায়ে ডিজাইন পরিবর্তন ও ডিজাইনের মধ্যে নতুন অঙ্গ সংযোজন করার ফলে অতিরিক্ত সময় গেছে। এদিকে প্রকল্পের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ৫ জন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ পেয়েছেন। ফলে প্রকল্পের অগ্রগতি মন্থর রয়েছে। আইএমইডির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সরেজমিন প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনের সময় ইটের শক্তি ঠিক থাকলেও আকৃতিগতভাবে ইটগুলোর রেগুলারিটি ছিল না। অন্যদিকে যে খোয়া বা চিপ ব্যবহার করা হচ্ছিল সেগুলোর মধ্যে ডাস্ট মিশ্রিত ছিল এবং মান সন্তোষজনক ছিল না। পাশাপাশি নির্মাণাধীন অভ্যন্তরীণ ওয়ালের পিলারে স্ট্রিপ বা রিংয়ের স্পেস ঠিক ছিল না। এদিকে ‘ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কারাগার পুনর্নির্মাণ’ প্রকল্পের মূল ব্যয় ছিল ১২৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা। পরে ১১২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা বাড়িয়ে মোট ব্যয় করা হয় ২৪০ কোটি ১৫ লাখ টাকা। এর অনুমোদিত মেয়াদ ছিল ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত। কিন্তু মেয়াদ বাড়তে বাড়তে দাঁড়িয়েছে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত। এতে তিন বছরের এ প্রকল্পে সময় লাগছে ১০ বছর। এর মেয়াদ বেড়েছে ২৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ এবং ব্যয় বেড়েছে ৮৮ দশমিক ২০ শতাংশ। বাড়তি মেয়াদেও প্রকল্প শেষ হবে কি না তা নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা। কেননা প্রকল্পের প্রায় ৯ বছর পেরিয়ে গেলেও গত এপ্রিল পর্যন্ত ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৪৬ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৩৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। এমন দেরির কারণ সম্পর্কে জানা গেছে, এ প্রকল্পেরও সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়নি। এছাড়া যথাসময়ে মাস্টারপ্ল্যান তৈরি না হওয়া, রেট শিডিউল পরিবর্তন, পুরোনো স্থাপনা অপসারণে দেরি, পূর্ণকালীন প্রকল্প পরিচালক না থাকা এবং প্রকল্প চালু হওয়ার পর নতুন অঙ্গ সংযোজন করা।