চট্টগ্রামে আবারও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও গ্যাং সদস্যরা ঘটাচ্ছে নানা অঘটন। খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অপহরণসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই যা তারা করছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নানামুখী তৎপরতার পরও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না কিশোর অপরাধীদের। তাদের ভয়ে সাধারণ মানুষ তটস্থ থাকেন। কেননা কিশোর গ্যাং সদস্যদের এসব অপকর্মের মূলে থাকে তাদের কথিত ‘বড়ভাই’। শুধু নগরীতে নয়, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা এখন বিভিন্ন উপজেলায়ও তৎপর রয়েছে। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজি, সরকারি দপ্তরগুলোতে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, গার্মেন্ট ব্যবসা, জমি দখল, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল কিংবা কোণঠাসা করাসহ বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে গ্রুপিং, সংঘর্ষ ও খুনের ঘটনায় জড়িত কিশোর গ্যাং লিডাররা। আর গ্রুপ ভারী করতে কথিত বড়ভাইরা কিশোর তরুণদের বিপথগামী করে তুলছে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) হাতে কিশোর গ্যাং ও তাদের নিয়ন্ত্রক কথিত বড়ভাই বা গডফাদারদের একটি তালিকা রয়েছে। তবে এ তালিকার অধিকাংশই ধরাছোঁয়ার বাইরে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। সিএমপি ২০১৯ সালে এ তালিকা তৈরি করলেও কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। বিশেষ করে চকবাজার এলাকায় কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না কিশোর গ্যাং। বেপরোয়া গ্যাংগুলোর সংঘাত-সংঘর্ষ লেগেই আছে। এ এলাকায় অন্তত ৮-১০টি কিশোর গ্যাং ছিনতাইসহ নানা অপরাধে জড়িত দীর্ঘদিন। চকবাজার থানার চট্টেশ্বরী রোডের গাজী শাহ মাজার এলাকায় বৃহস্পতিবার রাতে দুই কিশোর গ্যাংয়ের সংঘর্ষে পাঁচজন গুরুতর আহত হয়েছেন। তারা হচ্ছেন-কলেজ ছাত্র জিকু দেব নাথ, আমিরুল ইসলাম রুবেল, সাজু দাশ, গোপাল ও ডালিম কুমার নাথ। আহতরা এখনো চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এ ঘটনায় গুরুতর আহত জিকু দেব নাথের মা অঞ্জনা রানী নাথ চকবাজার থানায় কিশোর গ্যাংয়ের ১৩ সদস্যের বিরুদ্ধে শনিবার সকালে মামলা করেছেন। আসামিরা হচ্ছে-রবিউল ইসলাম রাজু, মো. শাকিল, মো. রকিব. রাশেদুল ইসলাম রাব্বি, সাইফুল ইসলাম, মো. সাকিব, মো. জুয়েল ওরফে হামকা জুয়েল, জুম্মন, ইমাম হোসেন ইমাম, মোর্শেদ ওরফে খরগোশ মোরশেদ, হানিফ, সাইফুল ইসলাম-২ ও মো. হৃদয়। তবে তাদের কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে আগের একাধিক মামলাও রয়েছে। এর আগে ৬ ফেব্রুয়ারি নগরীর চান্দগাঁও থানাধীন কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকায় চাঁদা না দেওয়ায় কিশোর গ্যাং সদস্যরা আজমির হোসেন নামে এক অটোরিকশা চালককে মারধর ও ছুরিকাঘাত করে। ওই রাতেই আজমির কিশোর গ্যাং লিডার আজাদ ও তার তিন সহযোগীর বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেন। ২০২২ সালের ৮ এপ্রিল চেরাগী পাহাড় এলাকায় দুই কিশোর গ্যাং চক্রের সংঘর্ষের সময় ছুরিকাঘাতে জামালখান ওয়ার্ড ছাত্রলীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক আসকার বিন তারেক নিহত হন। সংঘাতে জড়িতরা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমনের অনুসারী হিসাবে পরিচিত। এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এ ঘটনা ঘটেছিল। এখনো প্রতিনিয়তই কিশোর গ্যাংয়ের সংঘাত লেগেই রয়েছে এলাকাটিতে। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র আদনানকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। পরে পুলিশ কিশোর গ্যাং ও মদদদাতাদের গ্রেফতারে অভিযান শুরু করলে নগরীতে কিছুটা কমে যায় তাদের দৌরাত্ম্য। সাম্প্রতিক সময়ে আবারও বেড়েছে কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা। নগরীতে ছিনতাইয়ের কবলে পড়েছেন এমন কয়েক ব্যক্তি জানান, তাদের টাকা-পয়সা ছিনতাইকারীদের বেশিরভাগের বয়স ১৪ থেকে ১৮ বছর। সন্ধ্যার পরে নগরীর স্টেশন রোড, বিআরটিসি মোড়, কদমতলী, চকবাজার, মেডিকেল হোস্টেল, শিল্পকলা একাডেমি, সিআরবি, খুলশী, ফয়েজ লেক, ডেবারপার, চান্দগাঁও শমসের পাড়া, ফরিদের পাড়া, আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনি, সিডিএ, ছোটপুল, হালিশহর, বন্দর কলোনি ও পতেঙ্গার বেশ কয়েকটি এলাকায় মাদক বেচাকেনা, মোটরসাইকেল ও সাইকেল ছিনতাই করছে তারা। গান-বাজনা, খেলার মাঠ, ড্যান্স ও ডিজে পার্টি, বিভিন্ন ক্লাবের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখতে চায় এসব কিশোর গ্যাং। ২০১৮ সালের এপ্রিলে স্কুলছাত্রী তাসফিয়া আমিন হত্যা মামলার মধ্য দিয়ে আবিষ্কার হয় ‘রিচ কিডস’ নামে একটি কিশোর গ্যাংয়ের অস্তিত্ব। মামলার প্রধান অভিযুক্ত আদনান মির্জা গ্রুপটির নেতৃত্বে ছিল। সিএমপির এডিসি (পিআর) স্পিনা রানী প্রামাণিক বলেন, বিষয়টি আমাদের নজরেও এসেছে। সিএমপি এ ব্যাপারে কাজ করছে। অপরাধ করলে কোনো ছাড় নেই।