কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নিয়ে গ্রেফতার ও পুলিশি হয়রানির আতঙ্কে বহু শিক্ষার্থী ঘরছাড়া হয়েছেন। আন্দোলনে সরাসরি অংশ না নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমর্থন জানানো শিক্ষার্থীরাও রয়েছেন ভয়ে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসাবাড়িতে ক্রমাগত তল্লাশি ও শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক মামলায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন অধিকাংশ শিক্ষার্থী। যদিও কোটা সংস্কারের দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা ও পুলিশি হয়রানি করা হবে না বলে জানিয়ে আসছে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা। পুলিশের দাবি, কোটা সংস্কার আন্দোলনে শান্তিপূর্ণভাবে অংশ নেওয়া কোনো শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার কিংবা হয়রানি করা হচ্ছে না। আন্দোলনে যারা সহিংসতায় জাড়িয়েছেন, বিভিন্ন স্থাপনা ও পুলিশের ওপর আক্রমণ করেছেন এমন ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। যাদের মধ্যে শিক্ষার্থী থাকতে পারে। তবে আন্দোলনের আড়ালে সহিংসতা ছড়ানো ব্যক্তিদের গ্রেফতার করতে গিয়ে যাতে সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থীরা কোনো হয়রানির শিকার না হয় সে বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানায় পুলিশ। যদিও এর ব্যতিক্রম ঘটনার অভিযোগ পাওয়া গেছে। আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা বলেছেন, কোটা আন্দোলনে অংশ নিয়ে অসংখ্য শিক্ষার্থী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছেন। এসব হত্যাকাণ্ডের তদন্ত না করে উলটো শিক্ষার্থীদের মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসাবাড়িতে গিয়ে তল্লাশি করা হচ্ছে। আন্দোলনে শান্তিপূর্ণভাবে অংশ নেওয়া বহু সাধারণ শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশের ক্রমাগত এমন কার্যক্রমে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। এমনকি ফেসবুকে আন্দোলনের সমর্থন জানানোয় স্থানীয় ছাত্রলীগের হাতে মারধরের শিকার হচ্ছেন অনেকেই। ফলে তাদের অনেকেই নিজের গ্রামে ফিরে গেছেন। কেউ কেউ বন্ধু ও স্বজনদের বাসায় অবস্থান করছেন। জানা গেছে, কোটা আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের খুঁজতে রাজধানীর কলাবাগান, নাখালপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকার বাসাবাড়িতে তল্লাশি চালায় পুলিশ। এ সময় শিক্ষার্থীদের আসবাবপত্র, মুঠোফোন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তথ্য যাচাই করা হয়। এ সময় আন্দোলনে অংশ নেননি, এমনকি শিক্ষার্থী নন এমন যুবকদেরও গ্রেফতার করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফলে এসব এলাকাসহ আশপাশের এলাকার শিক্ষার্থীদের মাঝে অতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এতে হয়রানি এড়াতে আন্দোলনে অংশ নেননি এমন শিক্ষার্থীসহ অধিকাংশরাই অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকার একটি মেসে থাকেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী। কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেওয়া এই শিক্ষার্থী পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে শুক্রবার বলেন, কলাবাগান এলাকায় শিক্ষার্থীরা থাকেন এমন মেসে পুলিশ যাচ্ছে, তাদের হয়রানি করছে। যারা আন্দোলনে অংশ নেননি এমন ছাত্রদেরও ছাড় দিচ্ছে না। বন্ধুদের মাধ্যমে এমন খবর পেয়ে আজ (শুক্রবার) বিকালে বাসা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যাচ্ছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার ঢাকায় ফিরে আসব। সহিংসতায় না জড়িয়েও গ্রেফতার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী। পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই শিক্ষার্থীর মা গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, আমার ছেলে ১৮ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেয়। সে কোনো সহিংসতা বা ভাঙচুরে জড়ায়নি। কিন্তু পুলিশ তাকে এই অভিযোগে ১৯ তারিখ গ্রেফতার দেখায়। আমরা এখন তার জামিনের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পুলিশি হয়রানির অভিযোগ অস্বীকার করেন পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (অপারেশনস) মো. আনোয়ার হোসেন। শুক্রবার মুঠোফোনে তিনি বলেন, আন্দোলনের নামে যারা সহিংসতা ছড়িয়েছে শুধু তাদের আইনের আওতায় আনার জন্য কাজ করছে পুলিশ। শান্তিপূর্ণভাবে অংশ নেওয়া কোনো সাধারণ শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না। অগ্নিসংযোগ ভাঙচুর ও পুলিশের ওপর হামলার মতো সহিংসতায় যারা জড়িয়েছেন শুধু তাদের শনাক্ত করে গ্রেফতার করা হচ্ছে। আমরা মনে করি না কোনো সাধারণ ছাত্র সহিংসতায় জড়িত। এদিকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অন্তত ২০টি মামলা করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে করা অধিকাংশ মামলার বাদী পুলিশ। এছাড়াও ছাত্রলীগ নেতারাও মামলার বাদী হয়েছেন। এর মধ্যে শাহবাগ থানায় ১২ থেকে ২১ জুলাইয়ের মধ্যে অজ্ঞাতনামা আন্দোলনকারীদের নামে ১১টি মামলা হয়েছে। ১৭ জুলাই রূপনগর থানায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিইউবিটির অজ্ঞাতনামা শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দুটি মামলা। ১১ জুলাই শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ শিক্ষার্থীর নাম উল্লেখ করে একটি মামলা করেছে পুলিশ। ১৭ জুলাই আশুলিয়া থানায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অজ্ঞাতনামা ছাত্রছাত্রীদের বিরুদ্ধে মামলা। এছাড়াও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫ শিক্ষার্থীসহ ২০ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে। রাজশাহী মহানগরের মতিহার থানায় ১৭ জুলাই মামলাটি করেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কাইয়ুম মিয়া। অন্যদিকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) প্রধান গেটে সহিংসতার ঘটনায় আটক ৩৮ শিক্ষার্থীকে বিস্ফোরক মামলায় বৃহস্পতিবার পুলিশের করা মামলায় শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হয়েছে।