তখন দুপুর দেড়টা। সাদা পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি পরা এক বৃদ্ধ আদালত চত্বরে ঢুকেই ডুকরে কেঁদে ওঠেন। এ সময় মৌচাকের মতো তাকে ঘিরে ধরে টিভি ক্যামেরা। জ্বলে ওঠে অর্ধশতাধিক মোবাইল ফোনের ডিসপ্লে। আশপাশ থেকে ছুটে আসেন তটস্থ আইনজীবীরাও। ভিড় ঠেলে কাছে গিয়ে জানা যায় বৃদ্ধের নাম মোজাম্মেল হক। পেশায় তিনি শিক্ষক। ছাত্র আন্দোলনে জড়িত থাকার অভিযোগে তার কলেজপড়ুয়া ছেলেকে ধরে এনেছে পুলিশ। সন্তানের জামিন নিতে গাজীপুর থেকে ছুটে এসেছেন ঢাকার আদালতপাড়ায়। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, তার ছেলে জাকি তাহসিন (১৯)। রাজধানীর অন্যতম নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিএফ শাহিন কলেজ থেকে এবার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে। ইতোমধ্যে তার ৭টা পরীক্ষা শেষ। কিন্তু বাকি পরীক্ষাগুলো অনিশ্চিত হয়ে গেছে। শ্রীপুর উপজেলার বাসিন্দা মোজাম্মেল জানান, পরীক্ষা স্থগিত থাকায় সোমবার বিকালে মেডিকেল কোচিংয়ের উদ্দেশ্যে গাজীপুর থেকে উত্তরায় আসে তার ছেলে। কোনো কিছু না বলেই রাস্তা থেকে আটক করে পুলিশ। পরে তাকে উত্তরা পূর্ব থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। ছেলে কি ছাত্র বিক্ষোভ বা ভাঙচুরে জড়িত ছিল-এমন প্রশ্নে মোজাম্মেল বলেন, কোনোভাবেই না। কারণ সে তো পরীক্ষার্থী। আমরা তাকে বাড়ি থেকেই বের হতে দিচ্ছি না। তাহলে সে রাস্তায় ভাঙচুর করবে কীভাবে। মঙ্গলবার বেলা ১টা ৪৫ মিনিট। আদালত ভবনের নিচতলায় লিফটের সামনে আসামিদের নিয়ে অপেক্ষমাণ কোর্ট পুলিশের সদস্যরা। আসামির সারিতে দাঁড়িয়ে আছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র আশিক। তার দুহাতে পুলিশের হাতকড়া। সোমবার টঙ্গী এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তিনি এখন বিক্ষোভ ও ভাঙচুর মামলার আসামি। গ্রেফতার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আসিক বলেন, পুলিশের হাতে গ্রেফতারে তিনি মোটেও ভীত নন। তাকে হয়তো বেশ কিছুদিন জেল খাটতে হবে। কিন্তু এটাই জীবনের শেষ নয়। সরাসরি তিনি কখনো কারাগার দেখেননি উল্লেখ করে আসিক বলেন, তার গ্রেফতারের খবর এখনো তার পরিবারের কাছে পৌঁছায়নি। জানি না সবাই জানলে তাদের মানসিক অবস্থা কেমন হবে। বন্ধুর গ্রেফতারের খবর পেয়ে আদালতে ছুটে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ে আসিকের সহপাঠী আব্দুল আজিজ। তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া এমন গ্রেফতার অভিযান সম্পূর্ণ অন্যায়, বেআইনি। এভাবে কাউকে হয়রানি করার অধিকার কোনোভাবেই পুলিশের নেই। অবিলম্বে এমন গণগ্রেফতার অভিযান বন্ধ করতে হবে। বেলা ২টা। একের পর এক আসামি বোঝাই প্রিজন ভ্যান ঢুকছে আদালত চত্বরে। গাড়ি ঢুকতে দেখলেই দায়িত্বরত সাংবাদিক ও আইনজীবীদের মধ্যে শোরগোল উঠছে। আইনজীবীরা একে অন্যের উদ্দেশে বলাবলি করছেন, আসামি কার। ডিবি। না থানা পুলিশের। ছাত্র কতজন ইত্যাদি। আদালতের গাড়ি বারান্দার নিচে ৫-৬ জন আইনজীবীর এক জটলায় কেউ একজন বলছেন, এখন একটাই মামলা। বিক্ষোভ অথবা ভাঙচুর। এ ধরনের মামলার আসামিতে কারাগার প্রায় ভরে গেছে। আরেক আইনজীবী বলেন, ১৪নং কোর্ট তো সেদিন প্রকাশ্যে রাষ্ট্রপক্ষকে বলেছেন, কাশিমপুর ভরে গেছে। এখন এত আসামি রাখবেন কোথায়। ছাত্র বিক্ষোভে জড়িত থাকার অভিযোগে সোমবার রাতে ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন টিভি নাটকের পরিচালক জহির। পরে তাকে খিলগাঁও থানায় হস্তান্তর করা হয়। ছোট ভাইয়ের গ্রেফতারের খবরে মঙ্গলবার বৃদ্ধ মাকে নিয়ে আদালতে ছুটে আসেন জহিরের বড় ভাই জামাল উদ্দিন। গারদের (হাজতখানা) সামনে দীর্ঘ সময় ধরে তিনি অপেক্ষমাণ ছিলেন। জামালের হাতে কিছু কাপড়চোপড় এবং কয়েকটি খাবারের প্যাকেট। হাতের মুঠোয় একটা সাদা কাগজের চিরকুট। এতে মোটা হরফে লেখা ‘বাড়ির লোকজন নিয়ে কোনো চিন্তা করিও না। গ্রেফতার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে জামাল উদ্দিন বলেন, সোমবার হঠাৎ তার ভাইয়ের মোবাইল ফোন বন্ধ হয়ে যায়। তার কোনো খবরই পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে জানতে পারেন ডিবি পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। এক পর্যায়ে খিলগাঁও থানায় খবর নিয়ে তারা ভাইয়ের সন্ধান পান। তার দাবি-আন্দোলনে জড়িত না থাকলেও অহেতুক সন্দেহের বশে জহিরকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বেলা তখন আড়াইটা। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। এর মধ্যেই গারদখানার গেটে খাবারের প্যাকেট হাতে দাঁড়িয়ে ভাষানটেকের বাসিন্দা দিলরুবা। তার ভাই সোহাগকে ধরে এনেছে পুলিশ। গারদের সামনে হাউমাউ করে কাঁদতে দেখে দিলরুবাকে ঘিরে ধরেন সাংবাদিকরা। এ সময় তিনি বলেন, তার ভাই প্রতিবন্ধী। একটা পা নষ্ট। ঠিকমতো হাঁটতেও পারে না। অথচ ছাত্র বিক্ষোভের ঘটনায় তাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তার অভিযোগ-২২ জুলাই তার ভাইকে আটক করা হলেও ২ দিন আটকে রেখে গ্রেফতার দেখানো হয় ২৪ তারিখ। প্রতিবন্ধী হলেও তাকে বিক্ষোভ ও ভাঙচুর মামলায় তাকে আসামি করা হয়েছে। তখন বেলা ৩টা। মোহাম্মদপুর থেকে ধরে আনা আরেক আসামিকে গারদ থেকে বের করতেই নাটকীয় ঘটনা ঘটে। সহস জনতার ভিড়েই স্বামীকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন তার স্ত্রী। বাবার লুঙ্গি আঁকড়ে কাঁদে তার এক শিশু কন্যা। এ সময় ধাক্কা দিয়ে সবাইকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন কোর্ট পুলিশের সদস্যরা। কিন্তু স্বামীকে ছাড়তে নারাজ তার স্ত্রী। অবশ্য শেষমেশ দায়িত্বরত সাংবাদিক ও আইনজীবীদের হস্তক্ষেপে স্বামীর হাত ছাড়েন ওই নারী। এক পর্যায়ে দুহাতে কান্না চেপে পুলিশের সঙ্গে হাঁটতে থাকেন তার স্বামী। নিচু স্বরে স্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, ‘বেশি চিন্তা করিও না। শিগগিরই ফিরে আসব।’ ভুক্তভোগীরা জানান, ছাত্র বিক্ষোভের ঘটনায় আকস্মিক গ্রেফতার অনেকে তাদের পরিবারের কাছে যথাসময়ে সংবাদ পৌঁছাতে পারছে না। ফলে আইনগত সহায়তার জন্য তার পক্ষে আদালতে কোনো আইনজীবী থাকছে না। এতে জামিন পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও অনেককে কারাগারে যেতে হচ্ছে। অবশ্য ছাত্র আন্দোলনের প্রতি একাত্মতা জানিয়ে ইতোমধ্যে আইনজীবীদের কেউ কেউ স্বেচ্ছায় অংশ নিচ্ছেন জামিন শুনানিতে। গ্রেফতার : আদালতের সাধারণ নিবন্ধন (জিআর) শাখা থেকে জানা যায়, মঙ্গলবার পর্যন্ত ছাত্র বিক্ষোভের ঘটনায় রাজধানীর বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে ২৭০টি। এতে আসামির সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার। মঙ্গলবার এসব মামলায় নতুন করে গ্রেফতার হয়েছেন ১৪১ জনের বেশি। এর মধ্যে অন্তত ২২ জন রাজধানী ও আশপাশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, বিক্ষোভ ও ভাঙচুরের ঘটনায় গত কয়েকদিনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটকের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। যাদের আটক করা হচ্ছে তাদের সবাইকে যথাসময়ে আদালতে হাজির করা হচ্ছে না। যাচাই-বাছাইয়ের কথা বলে সময়ক্ষেপণ করছে পুলিশ। এছাড়া গ্রেফতারের পরও অনেকের নাম-পরিচয় গোপন রাখা হচ্ছে। এতে যথাসময়ে আইনজীবী নিয়োগ থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে স্বজনদের হয়রানি আরও বাড়ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছাত্র বিক্ষোভ এবং ভাঙচুর মামলায় যেসব শিক্ষার্থী গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যাচ্ছেন তাদের বাকি জীবন অনেকটাই অন্ধকার হয়ে পড়বে। ভবিষ্যতে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করতে গেলে তারা বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হবেন। তখন নিয়মিত পুলিশ ভেরিফিকেশনে তাদের রিপোর্ট নেতিবাচক হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। এতে মেধা থাকা সত্ত্বেও পুলিশ রিপোর্টের কারণে অনেকেই হয়তো শেষ পর্যন্ত আর সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করতে পারবে না। নিরপরাধ শিক্ষার্থীদের গ্রেফতার ও হয়রানির অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডিএমপির প্রসিকিউশন বিভাগের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মোহাম্মদ নূরুল মোত্তাকিন মঙ্গলবার বলেন, হয়রানির অভিযোগ সঠিক নয়। যাদের বিরুদ্ধে ভাঙচুর ও সরকারি সম্পদ ধ্বংসে জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে শুধু তাদেরই গ্রেফতার করা হচ্ছে। অহেতুক নিরপরাধ কাউকে হয়রানি না করতে ডিএমপি’র উচ্চ পর্যায় থেকে কড়া নির্দেশ দেওয়া আছে।