তেল, গ্যাস, খনিজসম্পদ ও বন্দর-বিদ্যুৎ রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেছেন, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে এবং কারফিউ প্রত্যাহার করে সব ধরনের নির্যাতন-নিপীড়ন বন্ধ করতে হবে। আর এগুলো করতে হলে এই সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। শুধু পদত্যাগ করলেই হবে না, মুক্তিযুদ্ধকে যেমন জনগণের হাতে নিয়ে আসতে হবে, এই দেশকেও তেমনই জনগণের হাতে নিয়ে আসতে হবে। শুক্রবার রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ৩১টি সাংস্কৃতিক সংগঠন আয়োজিত জাতীয় শহিদ মিনার অভিমুখে পদযাত্রার প্রাক্কালে ‘রক্তের দাগ দিচ্ছে ডাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক’ শীর্ষক সংক্ষিপ্ত সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন। আনু মুহাম্মদ বলেন, ছাত্রদের আন্দোলনকে ঘিরে দেশি-বিদেশি অনেক ষড়যন্ত্র সক্রিয় রয়েছে। তাদের ফাঁদে পা দেওয়া থেকে সতর্ক অবলম্বন করতে হবে। তিনি বলেন, আমরা একটি ভয়ংকর সময় পার করছি এবং একই সময়ে আমরা একটি সৃষ্টিশীল সময় পার করছি। আমরা ভয়ংকর দমন-পীড়ন দেখছি। আবার অসাধারণ প্রতিরোধও দেখছি। আমরা দেখতে পাচ্ছি, ৩ থেকে ৭০ বছর পর্যন্ত নারী-পুরুষ, শ্রমজীবী, পেশাজীবী, শিক্ষার্থী, শিক্ষকের ওপর আক্রমণ আসছে। ভূমি ও আকাশ থেকে আক্রমণ আসছে। এই কয়দিনে ৩শর কাছাকাছি মানুষ নিহত হয়েছে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর গুলিতে। বাংলাদেশে এরকম রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞ! আমরা অনেক গণ-আন্দোলন দেখেছি, স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই বহুদিন থেকে করতে হয়েছে। গণতন্ত্রের লড়াই এখনো শেষ হয়নি। গণ-অভ্যুত্থান আমরা অনেক দেখেছি। কিন্তু মাত্র কয়দিনে এত প্রাণহানি বাংলাদেশ কখনো দেখেনি। তিনি বলেন, সারা দেশের মানুষ এখন মুক্ত হওয়ার জন্য লড়াই করছে। এই লড়াই এগিয়ে নিতে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। সংহতি বজায় রাখতে হবে। মুক্তিযুদ্ধকে দখলদারদের হাত থেকে মুক্ত করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের নাম নিয়ে জনগণের ওপর আক্রমণ আর চলবে না। বাংলাদেশে যারা খুনি-লুটেরা, যারা ফ্যাসিবাদ, তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের যত ক্ষতি করেছে, আর কোনো সরকার এত ক্ষতি করতে পারেনি। সেই মুক্তিযুদ্ধকে জনগণের হাতে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে। বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে লুটপাট করছে বলে অভিযোগ করে আনু মুহাম্মদ বলেন, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণ লড়াই করেছিল। লাখ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছে। সেই মুক্তিযুদ্ধকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে দেশের সম্পদ লুট হবে, দেশের মানুষের ওপর হত্যাকাণ্ড চলবে, জুলাই হত্যাকাণ্ডের মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটবে-সেটা আমরা কখনো মেনে নিতে পারি না। তিনি বলেন, এই সরকারের কাছে আমাদের চাওয়াপাওয়ার কিছু নেই। তাদের বিচার করার বিষয় আছে। অনেক বিচার জমে গেছে। সেই বিচার করতে হবে। আজ যারা বিভিন্নভাবে আহত ও নিহত রয়েছে, তাদের প্রতি আমাদের দায়- এ দেশকে মুক্ত করতে হবে। সেই মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের লড়াইয়ে ঐক্যবদ্ধ থেকে সব চক্রান্তকে মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে হবে। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে শুক্রবার দুপুরের পর থেকে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনের কয়েক হাজার নেতাকর্মী জড়ো হতে থাকেন। এ সময় বিভিন্ন প্রতিবাদী গান পরিবেশন করে ছাত্র-জনতা হত্যার বিচার চাওয়া হয়। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ পদযাত্রায় যোগ দেন। পদযাত্রা জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে থেকে শাহাবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি চত্বর হয়ে জাতীয় শহিদ মিনারে শেষ হয়। হত্যাকাণ্ডের দায় নিয়ে শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে : ছাত্র আন্দোলনে সংঘটিত সব হত্যাকাণ্ডের দায় নিয়ে শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে। আজ এ আন্দোলন সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণে গণ-আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সাংস্কৃতিক সমাবেশে বক্তারা এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমানের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তৃতা করেন সংগঠনের সহসভাপতি প্রবীর মিত্র, জামশেদ আনোয়ার তপন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তন্ময় প্রমুখ। এ সময় উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সদস্যরা প্রতিবাদী গান পরিবেশন করেন। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সহসভাপতি জামশেদ আনোয়ার তপন বলেন, যারা যৌক্তিক কোটা আন্দোলনের সঙ্গে ছিল, সরকার তাদের বিভিন্ন তকমা দিয়েছে। কোটি কোটি টাকা লুট, হত্যা, গুম করছে সরকারের অধীনে তাদের বিচার নেই। আমরা অনতিবিলম্বে এই স্বৈরাচারী সরকারের পতন চাই। প্রবীর মিত্র বলেন, সরকার স্বাধীনতাকে হরণ করে, গণতন্ত্রকে হরণ করে স্বৈরাচারী ব্যবস্থা কায়েম করেছে। মানুষ সেখান থেকে মুক্তি চায়। বদিউর রহমান বলেন, ছিল ছাত্রদের কোটা আন্দোলন। কিন্তু এখন তা বাংলার মানুষের আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। যা কিছু ঘটেছে, এর দায় সরকার এড়াতে পারে না। শিল্পীসমাজের বিক্ষোভ : কোটা সংস্কার আন্দোলনে হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে সরকারের পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে সমাবেশ ও বিক্ষোভ করেছে গণহত্যা ও নিপীড়নবিরোধী শিল্পীসমাজ। শুক্রবার রাজধানীর ধানমন্ডি আবাহনী মাঠের সামনে তারা এ কর্মসূচি শেষে একটি মিছিল বের করেন। শংকরে গিয়ে শেষ হওয়া মিছিলে অংশ নেন দৃশ্যশিল্পী, আলোকচিত্রশিল্পী, পারফরম্যান্সশিল্পী, সংগীতশিল্পী, কবি-লেখক-গবেষক-স্থপতি ও শিল্পসংগঠকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার হাজারো জনতা। সমাবেশে লিখিত বক্তব্যে শিল্পীসমাজের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় অবিচার, অনাচার ও জুলুমের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো কর্তব্য বলে উলেখ করা হয়। সমাবেশ শেষে প্রতিবাদী গান ও স্লোগান সহকারে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। এর পাশাপাশি শিল্পীরা অংশ নেন দেওয়াললিখন ও গ্রাফিতি অঙ্কন কর্মসূচিতে। তাদের কর্মসূচির মধ্যে ছিল ছাত্র হত্যা এবং নিপীড়ন প্রতিরোধের সব আন্দোলনের সঙ্গে সংহতির প্রকাশ, প্রত্যেক শহিদের নাম উচ্চারণ ও শিল্পীদের একত্রে ‘উপস্থিত’ বলা, ৮ থেকে ৯টি গান-কবিতা-একক পারফরম্যান্স, সংহতি প্রকাশ করে বক্তৃতা ও সমাপনী বক্তৃতা। কর্মসূচির সভাপতি ও শিল্পী-লেখক মোস্তফা জামান বলেন, নিজেদের ন্যায্য দাবি আদায় করতে গিয়ে শিক্ষার্থীসহ দুই শতাধিক মানুষকে প্রাণ দিয়েছেন। তাদের আমরা শহিদ বলছি। তাদের হত্যার বিচার চাইতে গেলে অনেক শিক্ষার্থীকে পুলিশ অত্যাচার করে গ্রেফতার করছে। হত্যার প্রতিকার ও হত্যাকারীদের বিচার দাবিতে আমরা শিল্পীসমাজ আজ এখানে সমবেত হয়েছি। আমরা তিন দফা দাবি উত্থাপন করেছি। তিন দফা দাবি হলো আটক শিক্ষার্থীদের দ্রুত মুক্তি দিতে হবে, কারফিউ তুলে নিয়ে জনগণের স্বস্তি ফিরিয়ে এনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিয়ে সরকারের গুন্ডা বাহিনীর বিচার করতে হবে, কোটা সংস্কার আন্দোলন দমনের নামে সংঘটিত সব হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য তদন্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে অবিলম্বে সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। সংগীতশিল্পী অরূপ রাহীর পরিচালনায় ও শিল্পী-লেখক মোস্তফা জামানের সভাপতিত্বে কর্মসূচিতে সমাবেশে শিল্পীদের মধ্যে অংশ নেন শিল্পী মোস্তফা জামান, ইমতিয়াজ আলম বেগ, আলোকচিত্রী অরূপ রাহী, সংগীতশিল্পী বিথী ঘোষ, কিউরেটর ও লেখক শেহজাদ চৌধুরী, শিল্পী ও কবি শাওন চিশতি, চিত্রশিল্পী কাজি তাহসিন আগাজ অপূর্ব, শিল্পী রাইয়ান ইসলাম, আলোকচিত্রশিল্পী মেহবুবা মাহজাবীন হাসান, চিত্রশিল্পী নুজহাত তাবাসসুম আনন, সাজান, তানজিম ইনিয়াত, নাঈম উল হাসান, কিউরেটর ও আর্কাইভিস্ট রীশাম শাহাব তীর্থ, স্থপতি ও চিত্রশিল্পী অসিত রায়, শিল্পী সুবর্ণা মোর্শেদা, চিত্রশিল্পী তাপসী, আফসানা শারমিন ঝুম্পা প্রমুখ।