ট্রমায় ভুগছে শিশুর পাশাপাশি বড়রাও

প্রকাশিতঃ অগাস্ট ৩, ২০২৪ | ৮:৪৭ পূর্বাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

কোটা সংস্কার আন্দোলনে ১৯ জুলাই পুলিশ ও শিক্ষার্থীদের মাঝে সংঘর্ষের সময় ঘরেই ছিল ১০ বছরের মো. শাফাত সামির। দুপুরে বাইরে থেকে আসা টিয়ারশেলের ঝাঁজালো ধোঁয়া থেকে বাঁচতে নিজ কক্ষের জানালা বন্ধ করতে যায় সে। ওই সময় একটি গুলি এসে সামিরের চোখ দিয়ে ঢুকে মাথা ভেদ করে পাশে থাকা চাচা মশিউরকে আঘাত করে দেওয়ালে গিয়ে ঠেকে। ছোট্ট সামিরের রক্তে রঞ্জিত দেওয়ালের ক্ষতচিহ্ন এখনো বলে দিচ্ছে বুলেটের আঘাতের গতি কতটা তীব্র ছিল! বুধবার রাতে রাজধানীর কাফরুলের হাউজিং স্টাফ কোয়ার্টারের ১৫ নম্বর বাড়ির দ্বিতীয়তলায় সঙ্গে কথা হয় সামিরের পরিবারের। এ সময় নাতির পড়ার টেবিলে থাকা বই-খাতা, আইডি কার্ড ও খেলনাসামগ্রী দেখিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন সামিরের দাদি। তিনি বলেন, ‘সামির মিরপুর-১৪ নম্বরে জামেউল উলুম মাদ্রাসার পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। নাতির স্বপ্ন ছিল বড় আলেম হবে, আমি মারা গেলে জানাজা পড়াবে। সারাক্ষণ ঘর আলোকিত করে থাকা সেই কলিজার টুকরা নাতিই আজ অন্ধকার কবরে শুয়ে আছে। এ কষ্ট আমি কেমন করে সইছি...! ওর মা-বাবাকে কীভাবে সান্ত্বনা দিচ্ছি। আমাদের সবার মনে যে ক্ষত ও ঝড় বইছে, আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে বোঝাতে পারব না।’ আঁচলে চোখের পানি মুছতে থাকেন তিনি। মনোবিদরা বলছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশে ঘটে যাওয়া সহিংসতা প্রত্যক্ষ করেছে সব বয়সের মানুষ। সৃষ্ট সহিংসতায় বহু তাজা প্রাণ ঝরেছে, এখনো অনেক মানুষ আহত হয়ে হাসপাতালের বিছানায় কষ্ট পাচ্ছে। হঠাৎ এত গুলির শব্দ, সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ, টিয়ারশেলের ধোঁয়া, বড় বড় ধারালো অস্ত্র শিশুরা দেখেছে। এত মারামারি, রক্ত আর বীভৎসতা দেখে শিশু থেকে শুরু করে বড়রাও ভীত-শঙ্কিত। টিভি-পত্রিকা খুললেই শিশু দেখেছে সহিংসতার দৃশ্য। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে পরিবারের সান্নিধ্য পেলে তারা এ পরিস্থিতি থেকে দ্রুত মুক্তি পেতে পারে। অন্যথায় এর প্রভাব পড়তে পারে দীর্ঘমেয়াদি। ২০ জুলাই সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জের চিটাগাং রোড এলাকায় সংঘর্ষের মাঝে পড়ে পায়ে গুলিবিদ্ধ হন সেলুনকর্মী রাকিব হোসেন। প্রথমে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় পরে তাকে জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান বা পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বুলেটবিদ্ধ ক্ষতস্থানে সংক্রমণ ধরায় চিকিৎসকরা রাকিবের বাম পা কেটে ফেলেছেন। কিন্তু ১৯ বছর বয়সি রাকিব পা হারানোর কষ্ট কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। আত্মীয়স্বজন কাউকে দেখলেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছেন, আমি কি আর কখনোই দুই পায়ে ভর করে হাঁটতে পারব না? আমাকে সারা জীবন পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে! রাকিবের বাবা কবির হোসেন বলেন, ঘটনার পর থেকে ছেলে ঘুমের মধ্যেও ভয়ে আঁতকে ওঠে। বিচ্ছিন্ন পা দেখে প্রায়ই পাগলের মতো কাঁদছে। চোখের সামনে ছেলের পা নেই দেখে পরিবারের সবাই মানসিক অস্থিরতায় ভুগছে। উত্তরার বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম বলেন, সংঘর্ষের সময় টানা দুইদিন কেউ বাসা থেকে বের হতে পারিনি। ছেলেমেয়েদেরও বাইরে বের হতে দিইনি। চারপাশে গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দে ছেলেমেয়েরাও ভীত ছিল। পরিস্থিতি এত ভয়াবহ ছিল যে সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েরা সেই ট্রমা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের বহির্বিভাগ ঘুরে চিকিৎসক, অভিভাবক ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে সেখানে অনেককে ট্রমার চিকিৎসা ও পরামর্শ নেওয়ার তথ্য জানা গেছে। বৃহস্পতিবার হাসপাতালটির বহির্বিভাগে পরামর্শ নিতে এসেছিলেন রামপুরার একটি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, গত কয়েকদিনের সংঘর্ষে তাদের হাসপাতালে প্রায় ৫০০ মানুষকে চিকিৎসা দিয়েছেন। চোখের সামনে তরতাজা মানুষকে প্রাণ হারাতে দেখেছেন। এ ঘটনায় তার স্বাভাবিক জীবনযাপন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, শুধু তিনিই নন, ১২ ও ৮ বছর বয়সি তার দুই মেয়ে সহিংসতার চিত্র দেখে ভয় পেয়েছে। ওরা পুলিশ ও ইউনিফর্ম পরা কাউকে দেখলেই গুলি করতে পারে ভেবে আতঙ্কিত হচ্ছে। তিনি নিজেও কর্মস্থলে মনোযোগ দিতে পারছেন না। তাই এখানে পরিচিত চিকিৎসকের কাছে কাউন্সেলিং করাতে এসেছিলেন। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক অধ্যাপক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মো. তাজুল ইসলাম বলেন, গত কয়েকদিনে মানুষ কিছু ভয়াবহ দৃশ্য ও অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা শিশুর ওপর বেশি প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে শিশুদের কমিউনিটি, ইমোশনাল ও সোশ্যাল ডেভেলমেন্ট বাধাগ্রস্ত হয়। এ আঘাত বা ট্রমা মস্তিষ্কে স্মৃতি হিসাবে থেকে যায় এবং পরে যখন তারা সামাজিক যোগাযোগ বা বিভন্ন মাধ্যমে এ ধরনের ভিডিও বা ঘটনার সম্মুখীন হয়, তখনও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ভুক্তভোগীদের মানসিক ট্রমা কামাতে ব্যক্তি, পরিবার, বন্ধু, আত্মীয়স্বজন, এমনকি সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রকে সহযোগিতা-সহমর্মিতার হাত বাড়াতে হবে।