রাজধানীবাসীর পয়ঃবর্জ্য পরিবেশবান্ধব উপায়ে শোধন করতে দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্প তৈরি করে ঢাকা ওয়াসা। কিন্তু বর্জ্য সংগ্রহের জন্য পাইপলাইন না করায় উদ্বোধনের দুই বছরেও কোনো গ্রাহককে সেবার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। প্ল্যান্ট চালু রাখার জন্য হাতিরঝিলের দূষিত পানি শোধন করে বালু নদীতে ফেলা হচ্ছে, যা প্রকল্পের উদ্দেশ্যপরিপন্থি। ঋণের টাকায় প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও এখনো কোনো রাজস্বও আদায় করতে পারেনি। অথচ প্রকল্পটির পরিচালন ব্যয় ও উৎপাদন অক্ষমতায় বছরে ৫১২ কোটি টাকা গচ্চা যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা ওয়াসাসংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, প্রকল্প চালুর পর ২০২২-২০২৩ ও ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে পরিচালন ব্যয় বাবদ খরচ হয়েছে ৩৬৩ কোটি টাকা। উৎপাদন অক্ষমতায় ঢাকা ওয়াসার গচ্চা গেছে দুই অর্থবছরে ৬৬২ কোটি টাকা। দুই খাত মিলে গচ্চা গেছে ১ হাজার ২৫ কোটি টাকা। সে হিসাবে বছরে গচ্চা ৫১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। বিগত দুই বছরের ক্ষতির কমবেশি চিত্র বহাল থাকবে ২০২৭ সাল পর্যন্ত। এরপর ঋণের কিস্তি শুরু হলে সুদ বাবদ বছরে ঢাকা ওয়াসার আরও ৭৮ কোটি টাকা দিতে হবে। পাশাপাশি ডলারের বর্ধিত মূল্যে সুদসহ বছরে ৩১৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হবে, যা ঢাকা ওয়াসার ওপর চাপ তৈরি করবে। ওই চাপ হ্রাস করতে ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষের পানির দাম বাড়ানোর বিকল্প কোনো পথ খোলা থাকবে না। কেননা ওই সময়ে দাশেরকান্দি প্রকল্প থেকে কোনো রাজস্ব আদায় শুরু হবে না। তারা বলেন, চায়না এক্সিম ব্যাংকের উচ্চ সুদের ঋণসহ সরকারের এবং ঢাকা ওয়াসার নিজস্ব অর্থে ৩৭১২ কোটি ৫৪ লাখ টাকায় দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল-ঢাকা শহরের গুলশান, বনানী, বারিধারা, বসুন্ধরা, মহাখালী, তেজগাঁও, মগবাজার, ইস্কাটন, নিকেতন, কলাবাগান, হাতিরঝিলসহ আশপাশের এলাকার পয়ঃবর্জ্য সংগ্রহ করে তা শোধন করা। ৫০ লাখ মানুষের সেবা দেওয়ার জন্য দৈনিক ৫০ কোটি লিটার পয়ঃবর্জ্য শোধন সক্ষমতাসম্পন্ন প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে। যদিও এখন তা নামকাওয়াস্তে চালু রাখা হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, দাশেরকান্দি পয়ঃবর্জ্য শোধনাগার প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ শুরুর সময়ে প্রকল্পের পয়ঃবর্জ্য সংগ্রহের লাইন তৈরির কাজ শুরু করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু প্রকল্প চালুর দুই বছরেও এর কাজ শুরুই করতে পারেনি ঢাকা ওয়াসা। বর্তমানে ঢাকা ওয়াসা রাজউক নির্মিত হাতিরঝিল প্রকল্পের চারপাশের বিদ্যমান ড্রেনেজ বাইপাস লাইনে আগত ড্রেনেজ ওয়াটার হাতিরঝিলের পূর্ব অংশের পয়ঃলিফট স্টেশনের মাধ্যমে লিফটের পর দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগারের মাধ্যমে শোধন করে বালু নদীর ময়লা পানিতে ফেলা হচ্ছে; যা প্রকল্পের উদ্দেশ্যের সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। আরও জানা যায়, ঢাকা ওয়াসার অদূরদর্শিতায় পয়ঃশোধনগার নির্মাণকালে বর্জ্য সংগ্রহের পাইপলাইন করা হয়নি। ২০১৫ সালের জুলাইয়ে অনুমোদিত প্রকল্প ২০২২ সালের জুনে শেষ হয়। এরপর দুই বছর অতিবাহিত হলেও সংগ্রহ লাইন নির্মাণ প্রকল্প প্রস্তাবও করা হয়নি। এখনো যদি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়, তা অনুমোদনের পর চালু করতে অন্তত ১০ বছর লাগবে। ততদিন এ প্রকল্প থেকে সেবা পাবে না নগরবাসী এবং ঢাকা ওয়াসা আদায় করতে পারবে না কোনো রাজস্বও। অথচ ২০২৭ সাল থেকে প্রকল্পের ঋণের কিস্তি শুরু হবে। পরিচালন ব্যয় ও ঋণের কিস্তি দিতে ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষের আবারও পানির দাম বাড়িয়ে মেটানো ছাড়া কোনো বিকল্প থাকছে না। সূত্র জানায়, ঢাকা ওয়াসার দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্পে দৈনিক ৫০ কোটি লিটার পয়ঃবর্জ্য শোধন করার কথা। ঢাকা ওয়াসার প্রতি ইউনিট আবাসিক পয়ঃবর্জ্য কর ১৫ টাকা ১৮ পয়সা ও বাণিজ্যিক পয়ঃবর্জ্য কর ৪২ টাকা। ঢাকা ওয়াসার বর্তমান আবাসিক গ্রাহক ৮৯ শতাংশ এবং বাণিজ্যিক গ্রাহক ১১ শতাংশ। সে হিসাবে ২০২২-২০২৩ এবং ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ৩৩১ কোটি টাকা করে উৎপাদন অক্ষমতায় ঢাকা ওয়াসার ক্ষতি হয়েছে ৬৬২ কোটি টাকা। এছাড়া ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ঢাকা ওয়াসার পরিচালন ব্যয় বাবদ খরচ হয়েছে ২২৫ কোটি টাকা। আর ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে পরিচালন ব্যয় বাবদ খরচ হয়েছে ১৩৮ কোটি টাকা। ঢাকা ওয়াসার এই বিপুল ব্যয় মেটাতে বারবার বাড়ানো হচ্ছে পানির দাম। তারা আরও জানান, ঢাকা ওয়াসার দাশেরকান্দি প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে অদূরদর্শিতার স্পষ্ট প্রমাণ মিললেও ব্যর্থতার জন্য শাস্তি না দিয়ে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের বিশেষভাবে পুরস্কৃত করা হয়েছে। এজন্য অভিযোগ উঠেছে, প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে। কেউ যাতে কর্তৃপক্ষের বিপক্ষে না যায়, সেজন্য সংশ্লিষ্টদের পুরস্কৃত করা হয়েছে। প্রকল্প পরিচালক মো. মোহসেন আলী মিয়াকে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী থেকে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে সাতজনকে সুপারসিট (ডিঙিয়ে) করে। এর আগে চারজনকে ডিঙিয়ে তাকে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বানানো হয়। অথচ তাদের ব্যাচে (৬ জনের) মধ্যে মেধায় তার অবস্থান ষষ্ঠ। দাশেরকান্দি প্রকল্পের কাজ শেষে ওই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত নির্বাহী প্রকৌশলী গাজী হাবিবুর হায়দারকে ২০ জনকে ডিঙিয়ে ৮১৫১ কোটি টাকায় বাস্তবায়নাধীন গন্ধবপুর পানি শোধনগার প্রকল্পের উপপ্রকল্প পরিচালক করা হয়েছে। আরেকজন মো. মোমতাজুর রহমান, তাকেও ১৮ জনকে ডিঙিয়ে উপপ্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ঢাকা ওয়াসার এক কর্মকর্তা জানান, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ঢাকা ওয়াসা পানি ও পয়ঃবিল বাবদ আয় করেছে ১ হাজার ৯০৩ কোটি ৮ লাখ টাকা। এ অবস্থায় পানির দাম ১০ শতাংশ বাড়ালে অতিরিক্ত আয় হবে ১৯০ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। আর একই অর্থবছরে দাশেরকান্দি প্রকল্পটি পূর্ণ সক্ষমতায় চললে ক্ষতি কমে যাওয়ায় পানির দাম বাড়ানোর কোনো প্রয়োজন হতো না। একই অবস্থা ঘটেছে পদ্মা (যশলদিয়া) পানি শোধনাগার প্রকল্পের ক্ষেত্রেও। সরবরাহ লাইন না করে প্রকল্প চালু করায় অর্ধেক উৎপাদনও করতে পারছে না। অথচ পুরোপুরি উৎপাদন করা গেলে ঢাকা ওয়াসা রুটিন খরচ, ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেও অনেক লাভ করতে পারত। এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ড. গোলাম মোস্তফা বলেন, ঋণ নিয়ে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করে হাতিরঝিলের নোংরা পানি শোধন করছে। যেখান থেকে কোনো রাজস্ব আসছে না। অথচ প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল গুলশান, বনানী, বারিধারা, বসুন্ধরা, তেজগাঁও এবং আশপাশের এলাকার ৫০ লাখ মানুষের পয়ঃবর্জ্য সেবা দেওয়া। এই লক্ষ্য নিয়ে প্রকল্পটি করা হলেও একজন গ্রাহককেও সেবা দিতে পারছে না। এভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করে ঢাকা ওয়াসা ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে, সরকারের দুর্নাম করছে এবং অতিরিক্ত ব্যয় মেটাতে গ্রাহকদের ওপর পানির দাম বাড়াচ্ছে। তিনি বলেন, ঢাকা ওয়াসার পদ্মা পানি শোধনাগার প্রকল্পটিও একই ধরনের। সরবরাহ লাইন ছাড়া প্রকল্প চালু করায় সক্ষমতার অর্ধেক পানি উৎপাদন হচ্ছে। এতে ঢাকা ওয়াসার বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। এ ক্ষতি কমানো গেলে গত দুই-তিন বছরে যে পানির দাম বাড়িয়েছে, এর প্রয়োজন হতো না। ক্ষতির এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে সামনে পানির দাম আরও বাড়াতে হবে। তিনি জানান, ঢাকা ওয়াসায় প্রকল্পের এমন অনিয়ম ও অব্যবস্থা থাকলেও মন্ত্রণালয় এসব বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ করে না। কার্যক্রম দেখে মনে হয়, মন্ত্রণালয় ঢাকা ওয়াসার হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে। কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : এ প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খানের বক্তব্য জানতে তার ব্যক্তিগত নম্বরে একাধিকবার ফোন করে এবং এসএমএস (খুদেবার্তা) পাঠিয়েও কোনো সাড়া মেলেনি। তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াসার উপব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা একেএম সহিদ উদ্দিন বলেন, দাশেরকান্দির সরবরাহ লাইন তৈরি করা হবে। তবে এখনো প্রকল্পটি সচল রাখা হয়েছে। হাতিরঝিল প্রকল্পের ড্রেনেজের পানি ওই ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে শোধন করে বালু নদীতে ফেলা হচ্ছে। এর প্রভাবে বালু নদী ও শীতলক্ষ্যা নদীর দূষণ কমেছে। যেটা শহরের পরিবেশ উন্নয়ন ও ঢাকা ওয়াসার পানি শোধন প্রকল্পকে সহায়তা করছে। কেননা শীতলক্ষ্যা থেকে পানি নিয়ে তা শোধান করে রাজধানীবাসীকে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। তিনি জানান, এ প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার যেসব অভিযোগ তোলা হচ্ছে, এর সুনির্দিষ্ট কোনো ভিত্তি নেই।