কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ সারা দেশে সহিংস ঘটনায় বহু হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় দুই শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। যাদের অধিকাংশই গুলিবিদ্ধ। এছাড়া অনেকেই গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন। রাজপথে বিক্ষোভ ছাড়াও কেউ কেউ নিজের বাসায় বা ছাদে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে, নিয়ম না থাকলেও বিক্ষোভ দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘প্রাণঘাতী অস্ত্র’ ব্যবহার করায় এমন প্রাণহানি ঘটেছে। বিষয়টি নিয়ে দেশে ও আন্তর্জাতিক মহলে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। সাধারণ নাগরিকদের আন্দোলন দমনে এমন প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার সংবিধান এবং মানবাধিকারের স্পষ্ট লঙ্ঘন বলে মনে করছেন আইনজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টরা। তবে জীবন ও সম্পদ রক্ষায় বাধ্য হয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুলি করেছে বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ একাধিক মন্ত্রী-এমপি। গণমাধ্যমের তথ্যে দেখা যায়, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সংঘর্ষে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১৬, ১৮, ১৯, ২০ ও ২১ জুলাই। এর মধ্যে ১৭ জুলাই কোনো মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। এছাড়া হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অনেকের মৃত্যু হয়। সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। তবে ঢাকায় নিহতের ঘটনাগুলোয় পুলিশ বাদী হয়ে করা বেশিরভাগ মামলায় বিক্ষোভকালে সন্ত্রাসী বা দুষ্কৃতকারীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে। গুলির ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আন্দোলনের সময় রাজপথে যেমন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, তেমনি নিজ বাসার ভেতরে ও ছাদে থাকা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তবে কতজন গুলিবিদ্ধ (বুলেট) হয়ে চিকিৎসা নিতে গেছেন, সেই হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে অনেক হাসপাতালে ভর্তি আহতদের শরীরে গুলির আঘাত আছে বলে জানা গেছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, সাধারণত বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ লাঠি, গরম পানি, ঠান্ডা পানি, রঙিন পানি, কাঁদানে গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপসহ রাবার বুলেট ব্যবহার করে। প্রয়োজনে বন্দুক থেকে গুলিও করে। তবে তা যেন কোমরের নিচে থাকে। তবে এবারের কোটা সংস্কার আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলির ঘটনা দেখে মনে হয়েছে, তারা আন্দোলন দমন নয়, গুলি করে মানুষ হত্যায় নেমেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, বিক্ষোভ দমনে আইনবহির্ভূতভাবে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে বলে তারা প্রমাণ পেয়েছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন শুক্রবার বলেন, পুলিশের কাছে সব ধরনের অস্ত্র থাকে। তবে সেগুলো ব্যবহারের কঠোর নিয়ম রয়েছে। ভয়াবহ পরিস্থিতি বা চূড়ান্ত অবস্থা তৈরি না হলে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারে বিধিনিষেধ রয়েছে। তিনি বলেন, বন্দুক ও রাইফেলের গুলির পার্থক্য আছে। বন্দুকের গুলি বেশি দূর গিয়ে আঘাত করতে পারে না। আবার রাবার বুলেটও পুরোপুরি রাবার দিয়ে তৈরি নয়, এর মাথায় রাবার থাকে। অন্যদিকে, ছররা গুলিও কাছ থেকে লাগলে ক্ষতি হয়। তিনি বলেন, কম ক্ষমতার শটগানের গুলি কাছ থেকে না লাগলে সাধারণত মানুষের মৃত্যু হয় না। তবে রাইফেলের গুলি বা বুলেট দূরে গিয়েও মানুষের মৃত্যু ঘটায়। এজন্য এসব প্রাণঘাতী অস্ত্র নিরস্ত্র মানুষের বিক্ষোভ দমনে ব্যবহারের নিয়ম নেই। পুলিশ প্রবিধানমালার ১৫৩ ধারায় আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার সম্পর্কে বলা আছে-ব্যক্তিগত আত্মরক্ষা বা সম্পত্তি রক্ষার অধিকার প্রয়োগে, বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করতে এবং কোনো কোনো পরিস্থিতিতে গ্রেফতার কার্যকর করতে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা যাবে। ব্যক্তিগত আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগের জন্য আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-নিজেদের এবং সরকারি সম্পত্তি, যেমন অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, মোটরযান, যানবাহন প্রভৃতি আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা বা হামলা মোকাবিলার জন্য যতটুকু শক্তি প্রয়োজন তার বেশি প্রয়োগ করা যাবে না। শুধু আত্মরক্ষার প্রয়োজনেও যথাযথ কারণ ছাড়া গুলি চালানো নিষিদ্ধ। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) নূর মোহাম্মদ শুক্রবার বলেন, পুলিশ সামরিক বাহিনী নয়। তারা যুদ্ধে অংশ নেয় না। তাদের কাজ সাধারণ নাগরিকদের সঙ্গে। এজন্য জনগণকে মোকাবিলার জন্য তাদের প্রচলিত আইন ও প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হয়। তিনি বলেন, আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রথমত ঢাল ব্যবহার ও লাঠিচার্জ, গ্যাস গ্রেনেড ব্যবহার, কাছাকাছি দূরত্বে শটগান ব্যবহার যেন কেউ মারাত্মক ইনজুরি বা মারা না যান। আর চূড়ান্ত অবস্থা তৈরি হলেও তখন নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। আর কখন গুলি ছুড়বে আর কখন ছুড়বে না সেটিও সিনিয়ররা বলবেন। তিনি বলেন, কাউকে মেরে ফেলার জন্য পুলিশকে কাজ দেওয়া হয়নি। কত সহজে কোন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে সেটি যোগ্যতা ও প্রশিক্ষণের ব্যাপার। এবারের আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের অবস্থা দেখে মনে হয়েছে, তদারকির বড় অভাব ছিল। তিনি বলেন, চাইনিজ রাইফেল ও বড় অস্ত্র এক্সট্রিম পরিস্থিতি তৈরি হলে এবং জানমাল রক্ষার কোনো অবস্থা তৈরি হলে ব্যবহার করা যাবে। তবে দেখতে হবে, কোনো মানুষ যেন মারা না যান। এবারের অবস্থা দেখে মনে হয়েছে, সব নিয়ম ও প্রশিক্ষণ ফেল করেছে। অনেকে ঘরের ভেতরেও গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন, যা গ্রহণযোগ্য নয়। এমন প্রবণতা ভয়ংকর। পুলিশের মনে হয়েছে, যত ইচ্ছে তত গুলি করব। সাবেক এই আইজিপি বলেন, সংবিধান প্রতিটি নাগরিককে মিছিল-মিটিং করার অধিকার দিয়েছে। ভাঙচুর বা নাশকতা না করলে সে অধিকারে হস্তক্ষেপ করা যাবে না। অথচ দেখা গেছে, কেউ মিছিল করতে গেলেই বাধা দেওয়া হয়েছে। যা সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং জাতিসংঘের সঙ্গে যে চুক্তি রয়েছে তারও লঙ্ঘন। এদিকে, আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সরাসরি তাজা গুলির ব্যবহার কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না এবং তাজা গুলি ব্যবহার না করার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না-জানতে হাইকোর্টে এক রিট করা হয়েছে। তবে এক বিচারক অসুস্থ থাকায় রিটের শুনানি হয়নি। সম্প্রতি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রতিবাদ দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রাণঘাতী ও মৃদু প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সিনিয়র ডিরেক্টর ডেপ্রোজ মুচেনা বলেন, বাংলাদেশ থেকে আসা ভিডিও এবং ছবির ক্রমাগত যাচাই ও বিশ্লেষণে সেখানকার ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। পুলিশের প্রতি কোনো হুমকির কারণ ছিল না, এমন ব্যক্তিদের ওপর ইচ্ছাকৃত এবং অযৌক্তিক আক্রমণ করা হয়েছে। বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে যেভাবে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে এটি প্রতীয়মান হয় যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো মানুষের জীবনের প্রতি চরম উদাসীন ও অবমাননাকর আচরণ করেছে এবং তারা মানবাধিকার আইনের কোনো তোয়াক্কা করেনি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সাবেক নির্বাহী পরিচালক নুর খান লিটন বলেন, নিরস্ত্র মানুষের আন্দোলন বিক্ষোভ দমনে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার সুস্পষ্ট মানবাধিকারের লঙ্ঘন। এভাবে কোনো মানুষকে হত্যার দায়িত্ব কোনো বাহিনীকে দেওয়া হয়নি।