‘আল্লাহই জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান। আর আল্লাহ সর্ব আমল সম্পর্কে সম্যক অবহিত। যদি একজন নেতা চলে যায়, আরেকজনের উত্থান হবে।’ স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা ইসমাইল হানিয়া খামেনির সঙ্গে কথা বলার সময় টেলিভিশনে প্রচারিত এই মন্তব্য বিশেষভাবে ধারণ করা হয়। ইরানে গুপ্তহত্যার শিকার হন ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাসের শীর্ষ নেতা ইসমাইল হানিয়া। তেহরানে নিহত হওয়ার আগে ইসমাইল হানিয়া ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ আলী খামেনিকে শেষ কথায় জীবন, মৃত্যু, আমৃত্যু, সহনশীলতা নিয়ে কোরআনের এই আয়াত বলেছিলেন। এগুলোই ছিল খামেনির সঙ্গে ইসমাইল হানিয়ার শেষ কথা। এর কয়েক ঘণ্টা পর তেহরানের অতিথি ভবনে হামলায় নিহত হন এই স্বপ্নদ্রষ্টা। গত বুধবার এক বিবৃতিতে হামাস জানায়, ইরানের রাজধানী তেহরানে তার বাসস্থানে ‘জায়নবাদী গুপ্ত হামলায়’ এ ঘটনা ঘটেছে। হামাস জানিয়েছে, মঙ্গলবার ইরানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার পর তাকে হত্যা করা হয়। ইরানের স্থানীয় সময় রাত ২টার দিকে বিমান হামলা চালিয়ে তাকে হত্যা করা হয় বলে জানা গেছে। গত এপ্রিলে ইসরাইলি বিমান হামলায় তার তিন ছেলে ও চার নাতি-নাতনি এবং অন্তত ৬০ জন আত্মীয় নিহত হয়। সেই পরিস্থিতিতে হানিয়া বলেছিলেন, আমার সন্তানদের রক্তের চেয়ে ফিলিস্তিনি জনগণের শিশুদের রক্ত আমার কাছে বেশি গুরুত্বের। ফিলিস্তিনের সব শহীদ আমারই সন্তান। শহীদদের রক্ত এবং আহতদের কষ্টের বিনিময়ে আমরা ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখি। তাদের এই ত্যাগের বিনিময়েই আমরা আমাদের জনগণের জন্য স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখি। তার এই জীবন দর্শন হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনের দ্বারা প্রভাবিত। তিনি ইসরাইলের বিরুদ্ধে জিহাদের পক্ষে ছিলেন। ২০০৪ সালে ইয়াসিন ইসরাইলের হাতে নিহত হলেও সামরিক শক্তি হিসেবে হামাস ক্রমেই শক্তিশালী হতে থাকে। ১৯৯৪ সালে গাজায় রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হানিয়া বলেছিলেন, ইয়াসিন তাদের শিখিয়েছেন, ফিলিস্তিনিরা কেবল সংগ্রামের মাধ্যমেই তাদের দখলকৃত মাতৃভূমি পুনরুদ্ধার করতে পারে। তিনি শেখ ইয়াসিনের কাছ থেকে শিখেছেন ইসলামের প্রতি ভালোবাসা এবং এই ইসলামের জন্য আত্মত্যাগ এবং অত্যাচারী ও স্বৈরাচারীদের কাছে নতজানু না হওয়া। ফিলিস্তিনি সমর্থকদের কাছে হানিয়া এবং হামাস নেতারা মানেই ইসরাইলি দখলদারিত্ব থেকে মুক্তির পথ। ইসমাইল আবদেল সালাম হানিয়া, যার ডাক নাম আবু আল-আবদ। তিনি জন্মেছিলেন ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরে। তিনি হামাস আন্দোলনের রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান এবং ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ সরকারের দশম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ২০১৭ সালের ৬ মে থেকে তিনি হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। ইসমাইল হানিয়া আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। ২০১৭ সালে হামাসের শীর্ষ পদে নিয়োগ পাওয়া হানিয়া অবরুদ্ধ গাজায় ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে তুরস্ক ও কাতারের রাজধানী দোহা যান। তাকে যুদ্ধবিরতি আলোচনায় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করতে বা হামাসের মিত্র ইরানের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দেওয়া হয়। গত ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাস যোদ্ধাদের হামলায় এক হাজার ২০০ মানুষ নিহত ও ২৫০ জনকে জিম্মি করার পর ইসমাইল হানিয়া আরব দেশগুলোর উদ্দেশে বলেছিলেন, তারা (আরব দেশগুলো) ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার যে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, তাতে এই সংঘাতের অবসান ঘটাবে না। ইসরাইলের প্রতিক্রিয়া ছিল একটি সামরিক অভিযান, সেই অভিযানে এখন পর্যন্ত গাজার অভ্যন্তরে প্রায় ৪০,০০০ মানুষকে হত্যা করেছে এবং ছিটমহলের বেশিরভাগ অংশে বোমা ফেলে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিলিস্তিন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আদিব জিয়াদেহ বলেন, হামাস একটি আদর্শ এবং হানিয়াকে হত্যা করে দলটিকে শেষ করা যাবে না। জিয়াদেহ বলেন, যখনই হামাস একজন নেতাকে হারায়, আরেকজন নেতা আসে, কখনো তার কর্মক্ষমতা ও হামাসের নীতি পূরণে আরও শক্তিশালী হয়। গত মাসে গাজায় ইসরাইলি বিমান হামলায় ৭ অক্টোবরের হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী মোহাম্মদ দেইফ নিহত হয়েছেন বলে বৃহস্পতিবার জানিয়েছে ইসরাইল। হামাসের সামরিক শাখার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সালেহ আল-আউরিও ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে বৈরুতের দক্ষিণ শহরতলিতে ইসরাইলি ড্রোন হামলায় নিহত হন।