বেক্সিমকো-নাসার অর্থ পাচারে সায় বিএফআইইউর!

প্রকাশিতঃ অগাস্ট ১৮, ২০২৪ | ৭:০০ অপরাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

কিভাবে ঠেকাবেন অর্থ পাচার। যারা এই কাজে নিয়োজিত তারাই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে অর্থ পাচারে সহায়তাকারী। বেক্সিমকো ও নাসাসহ রাজনৈতিকভাবে বিভিন্ন প্রভাবশালী গ্রুপের অর্থ পাচারের সময় সম্পূর্ণ চুপ ছিল বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এই অপকর্মে বিএফআইইউর সদ্য পদত্যাগী প্রধান একা নন, তার সঙ্গে অন্তত অর্ধ-ডজনেরও বেশি কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে উঠেছে অর্থ পাচারে সহায়তা ও ঘুস নেওয়ার অভিযোগ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা এসব অভিযোগ করেন। তাদের মতে, নিরপেক্ষ তদন্ত হলে অর্থ পাচারের সব তথ্য বেরিয়ে আসবে। সম্প্রতি কর্মকর্তাদের বিক্ষোভের মুখে পদ ছাড়তে বাধ্য হন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান, মো. খুরশেদ আলম, উপদেষ্টা আবু ফরাহ মো. নাছের ও বিএফআইইউ প্রধান মাসুদ বিশ্বাস। এদের মধ্যে ৫ আগস্ট থেকে পলাতক ছিলেন গভর্নর। এরপর ৯ আগস্ট পলাতক অবস্থায় পদত্যাগ করেন তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা গণমাধ্যমকে দেওয়া লিখিত অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেন, সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপ এবং নজরুল ইসলাম মজুমদারের নাসা গ্রুপের সন্দেহজনক লেনদেন কখনো তদন্ত করা হয়নি। একজন অতিরিক্ত পরিচালক এবং বিএফআইইউ প্রধান তারা নিজেরাই গ্রুপ দুটির লেনদেন দেখভাল করতেন। সে কারণে এসব কেস কেউ তদন্ত করার সাহস পেতেন না। অর্থাৎ বেক্সিমকো এবং নাসা গ্রুপের অর্থ পাচারে বিএফআইইউর নীরব সায় ছিল। শুধু তাই নয়, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী কোনো ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচার ঠেকানো তো দূরে থাক; ন্যূনতম চেষ্টাও করেনি বিএফআইইউ। বরং দেখা গেছে উলটো চিত্র। অভিযোগপত্রে আরও উল্লেখ করা হয়, বিএফআইইউর তিনজন অতিরিক্ত পরিচালক, দুজন যুগ্ম পরিচালক এবং একজন উপপরিচালক বিভিন্ন সময়ে শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের থেকে ঘুসের মাধ্যমে অনিয়মে সহায়তা করেছেন। সহায়তা করেছেন অর্থ পাচারেও। পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ভুয়া তদন্ত রিপোর্ট তৈরি করে হয়রানিসহ ঘুস দাবি করেছেন। ঘুস না দিলে দুদকে অভিযোগ প্রেরণসহ নানাভাবে হেনস্তার অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। অভিযোগপত্রে বলা হয়, বিএফআইইউর একজন অতিরিক্ত পরিচালক এনসিসি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোসলেহ উদ্দীন আহমেদকে ব্ল্যাকমেইল করার উদ্দেশে তার ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করে অপর অতিরিক্ত পরিচালক ও একজন যুগ্ম পরিচালক সমন্বয়ে গঠিত পরিদর্শন দলের মাধ্যমে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পরিদর্শন প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন এবং দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) প্রেরণ করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ওই প্রতিবেদন চ্যালেঞ্জ করলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিসেস ডিপার্টমেন্ট (এফআইসিএসডি) থেকে নিরপেক্ষ পরিদর্শন প্রতিবেদনের মাধ্যমে তিনি দুদকের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পান। তখন দুদক দায়মুক্তিপত্রে উল্লেখ করা হয়, মোসলেহ উদ্দীন আহমেদের বিরুদ্ধে বিএফআইইউর আনীত অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত না হওয়ায় তা পরিসমাপ্ত করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নোটিংয়েও একই কথা উল্লেখ করা হয়। শুধু তাই নয়, সিলেটের দ্য প্যালেসের মালিকের স্কাই ক্যাপিটাল এয়ারওয়েজের অর্থ পাচারের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য ওই প্রতিষ্ঠানের মালিকের স্পন্সরশিপ ও আতিথেয়তায় যুক্তরাষ্ট্রে ট্যুর করে বিএফআইইউ প্রতিনিধিদল। এছাড়া পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান হিমাদ্রি লি.র ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করে তাদের কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা ঘুস আদায় করেন একজন অতিরিক্ত পরিচালক। পরে নির্ধারিত সময়ের আগেই তিনি ব্যাংক হিসাব আনফ্রিজ করেন। হিমাদ্রি লি.র শেয়ার প্রাইস ম্যানিপুলেশনের সঙ্গে বিএফআইইউ প্রধান ও একজন অতিরিক্ত পরিচালক জড়িত থেকে শেলটেক সিকিউরিটিজের মাধ্যমে মানি লন্ডারিং করার অভিয়োগ রয়েছে। অভিযোগে আরও দেখা যায়, পাঁচ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ভুয়া সুপারি রপ্তানি দেখিয়ে মোটা অঙ্কের নগদ প্রণোদনা আত্মসাতের ঘটনা ধরা পড়ে বিএফআইইউর তদন্তে। অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শেষ পর্যন্ত সে তদন্ত প্রতিবেদন দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানো হয়নি। অভিযোগ রয়েছে বিএফআইইউর একজন একজন অতিরিক্ত পরিচালক অনৈতিক সুবিধার বিনিময়ে বিষয়টি ধামাচাপা দেন। অভিযোগকারীরা বলছেন, কেউ ২০০৬ সাল এবং কেউ ২০০৮ সাল থেকে বিএফআইইউতে বহাল রয়েছেন। এভাবে টানা ১৬-১৮ বছর একই বিভাগে। অথচ দেশের কোনো গোয়েন্দা বা তদন্ত সংস্থায় ৫ বছরের বেশি একই সংস্থায় পদায়িত থাকার নিয়ম নেই। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিএফআইইউকে ঢেলে সাজানোর দাবি জানান তারা। দেশের অর্থ পাচার ঠেকাতে ২০০২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে ‘অ্যান্টি মানি লন্ডারিং ডিপার্টমেন্ট বা এএমএল’ নামে একটি বিভাগ গঠিত হয়। পরে অধিকতর কাজের উদ্দেশে ২০১২ সালের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে গঠিত হয় বিএফআইইউ। একযুগ পেরিয়ে গেলেও প্রতিষ্ঠানটি অর্থ পাচার ঠেকাতে তেমন কোনো দক্ষতা দেখাতে পারেনি। শুধু তাই নয়, নানা সময়ে প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে উঠেছে বিস্তর অনিয়মের অভিযোগ।