বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণভ্যুত্থানে প্রাণ হারিয়েছেন শত শত মানুষ। আন্দোলনে সম্পৃক্ত শিক্ষার্থী-সাধারণ মানুষ ছাড়াও এই তালিকায় বিএনপি-জামায়াতের অসংখ্য নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। এমনটাই দাবি দল দুটির দায়িত্বশীল মহলের। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী (১৮ আগস্ট পর্যন্ত) এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৯৭ জনে। এর মধ্যে বিএনপির অন্তত ১১৩ জন ও জামায়াতের রয়েছেন ৮৪ জন। সবচেয়ে বেশি হতাহত হয়েছেন-ছাত্রদল, যুবদল ও শ্রমিক দল ও ছাত্র-শিবিরের নেতাকর্মীরা। গুলিবিদ্ধ হয়ে এখনো মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন অনেকেই। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে এমনটাই জানিয়েছেন নেতারা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এদিকে ১৬ আগস্ট জাতিসংঘের এক প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৩২ শিশুসহ মোট নিহত হয়েছেন ৬৫০ জন। জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সারা দেশে ছাত্রদলের ৩৪, যুবদলের ৩৫, শ্রমিক দলের ১৪, স্বেচ্ছাসেবক দলের ৯, কৃষক দলের ৪, মহানগর উত্তর বিএনপির ৬, দক্ষিণ বিএনপির ৮, মৎস্যজীবী দলের ২, জাসাসের ১ জন নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে অন্তত ৩০ জনের বেশি নিহত হয়েছেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের। অসমর্থিত সূত্রের দাবি, ১৮ আগস্ট পর্যন্ত জামায়াত-শিবিরের ৮৪ জনের তালিকা করেছে জামায়াতে ইসলামী। তবে এই তালিকা প্রকাশে নারাজ দলটির নীতিনির্ধারকরা। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আন্দোলনে ছাত্রদল, যুবদলসহ বিএনপির অসংখ্য নেতাকর্মী মারা গেছেন। সঠিক সংখ্যা এখনই বলা যাচ্ছে না। তালিকা হচ্ছে। আহতদের মধ্যেও অনেকে মারা যাচ্ছেন। প্রতিদিনই মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। দলটির নেতারা জানান, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হতাহতের তালিকা করছে বিএনপি। একই সঙ্গে দল ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নিহতদের তালিকা প্রস্তুতির কাজও চলমান রয়েছে। এ পর্যন্ত নিহত ১১৩ নেতাকর্মীর তালিকা পৌঁছেছে দপ্তরে। পাশাপাশি আহত ও নিহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে দলটি। হতাহতদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সরেজমিন সাক্ষাৎ ও আর্থিক সহযোগিতা করতে কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহত নেতাকর্মীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা করতে পারেনি বিএনপি। কারণ হিসাবে নেতারা বলেছেন, সরকার পতনের পর সারা দেশে নৈরাজ্য চালাচ্ছে বিভিন্ন মহল। সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় উপাসনালয়ে নিরাপত্তায় কাজ করছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। প্রত্যেক জেলা, মহানগর ও উপজেলায় চিঠি পাঠিয়ে আহত-নিহতদের বিষয়ে তালিকা পাঠানোর নির্দেশনা দেওয়া হলেও পুরো তথ্য এখনো পায়নি বিএনপি। অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতারা বলছেন, প্রত্যেক সংগঠনের অসংখ্য নেতাকর্মী গুলিবিদ্ধ রয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। সারা দেশে মুমূর্ষু অবস্থায় চিকিৎসাধীন কয়েক সহস্রাধিক নেতাকর্মী। অনেকেই অন্ধ হয়েছেন, পা কেটে ফেলতে হয়েছে। এতে হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। প্রতিদিনই তাদের কোনো না কোনো রাজনৈতিক সহকর্মী চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাচ্ছেন। আন্দোলনে বিএনপি ও তার অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নিহত নেতাকর্মীদের তালিকা পেয়েছে । জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের এই তালিকায় নিহতরা হলেন-দক্ষিণখান থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মী মো. সাগর, বিমানবন্দরের শাহরিয়ার হোসেন আবির, যুবায়ের হোসেন, ঢাকা মহানগর উত্তর ৩৯নং ওয়ার্ডের সদস্য মো. মনির হোসেন, রূপনগর থানা ৬নং ওয়ার্ডের সহসভাপতি মিরাজ, ভাটারা থানার যুগ্ম আহ্বায়ক আল আমিন হোসেন আগমন চিশতী, ঠাকুরগাঁও পৌর শাখার সাধারণ সম্পাদক আল মামুন, রহিমানপুর ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শাহান পারভেজ, কুমিল্লা দেবিদ্বার পৌর যুগ্ম আহ্বায়ক মো. রুবেল মিয়া। শ্রমিক দলের নিহতরা হলেন-কদমতলী থানা ৬০নং ওয়ার্ডের সদস্য মো. জাহাঙ্গীর, পাওয়ার গ্রিড করপোরেশন বাংলাদেশের মো. রাকিব, মুগদা থানার সদস্য জালাল উদ্দিন, খিলগাঁও থানার মো. মনির হোসেন, মোহাম্মদপুর ৩৩নং ওয়ার্ডের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. আক্তার হোসেন, সদস্য মোহাম্মদ হোসেন, পল্লবী ৩নং ওয়ার্ডের সদস্য মোহাম্মদ আসিফ, গুলশান ১৮নং ওয়ার্ডের মো. মনির হোসেন, গুলশান থানার সদস্য মো. সোহাগ, কাফরুল ৪নং ওয়ার্ডের যুগ্ম আহ্বায়ক মোহাম্মদ রাজন, নরসিংদীর জাহাঙ্গীর আলম, ফরিদপুরের মো. শামছু মোল্লা, শিবচরের হৃদয় হাওলাদার, হবিগঞ্জের মোস্তাক মিয়া। এদিকে এ পর্যন্ত সংগঠনের ৩৫ জন নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন যুবদলের নেতারা। এর মধ্যে ঢাকায় নিহত হয়েছেন-হাফিজুর রহমান, মোসলেহউদ্দিন, ওবায়দুল, সজীব, মহিনউদ্দিন, শাহনেওয়াজ, নবীন তালুকদার, ওয়াসীম শেখ, সাঈদ খান, নাদিম, শামীম হাওলাদার, মহিউদ্দিন বয়াতি, ওমর ফারুক, শিহাবউদ্দিন, মোসলেমউদ্দিন, আরিফ, রিয়াজ, মোসলেম উদ্দিন মিলন, মেরাজুল ইসলাম, সাজ্জাদ হোসাইন, ইমন হাজী, নারায়াণগঞ্জ জেলায় মুহাম্মদ পারভেজ, মহানগর যুবদল নেতা সাজন, কুমিল্লা দক্ষিণ যুবদল নেতা মোহাম্মদ মাসুম, গাজীপুর মহানগরে নুর আলম, রাজশাহীতে আজিজুল হক এছাড়াও তালিকায় বেশ কয়েকজনের নাম রয়েছে। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নিহত নেতাদের মধ্যে রয়েছেন-মাগুরার মেহেদী হাসান রাব্বি, মুন্সীগঞ্জের মানিক মিয়া শারিক, ফরিদ শেখ, চট্টগ্রামের মোহাম্মদ ওয়াসিম আকরাম, ঢাকা মহানগর পূর্ব ছাত্রদলের আরিফুর রহমান রাসেল, যশোরের সাকিবুল হাসান মাহি, তানভীর রাইহান আলিফ ও ইউসুফ আলী, রাজবাড়ীর সাগর আহমেদ, হবিগঞ্জের রিপন চন্দ্র শীল, গেণ্ডারিয়া থানার ইসমাইল হোসেন রাব্বি, সূত্রাপুর থানার শাওন, জামালপুরের মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম, সিরাজগঞ্জের মোহাম্মদ সুমন, ঢাকা মহানগর পশ্চিম শাখার ছাত্রদলের শামিম হাওলাদার, ভাটারা থানা ছাত্রদল নেতা মনির হোসেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল নেতা ইরফান ভূঁইয়া, ইমতিয়াজ আহমেদ, শেরপুর সদর ৬নং পাকুরিয়া ইউনিয়ন ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব প্রমুখ। জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের চারজন নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে। এর মধ্যে ডেমরা থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক মোহাম্মদ শরীফ, বাড্ডা থানার সদস্য মোহাম্মদ সুমন, তেজগাঁও থানার ২৪ নাম্বার ওয়ার্ডের যুগ্ম আহ্বায়ক জাহিদুর ইসলাম, উত্তরা পূর্ব থানা কৃষক দল নেতা জাহিদুল ইসলাম সাগর। মৎস্যজীবী দলের যাত্রাবড়ী থানার যুগ্ম আহ্বায়ক মো. হৃদয়, গাজীপুর মহানগরের গাছা থানার ৩৫নং ওয়ার্ড সভাপতি রুবেল মিয়া ছাড়াও জাসাসের উত্তরা পূর্ব থানার আহ্বায়ক কমিটির সদস্য জসিমউদ্দিন নিহতের তালিকায় রয়েছেন। আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী আরও বলেন, বিশ্বের ইতিহাসে এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ডের নজির নেই। পাখির মতো গুলি করে গণতন্ত্রকামী ছাত্র-জনতাকে মেরেছে। গণহত্যা চালিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেয়েছে শেখ হাসিনা। ছাত্র-জনতার আন্দোলনেও আমাদের শত শত নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে। আওয়ামী লীগ ১৫ বছরে জঘন্যতম কাজগুলো করেছে। আমাদের হাজার হাজার নেতাকর্মী গুম, খুন, হত্যা করেছে। ফলে দায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, হতাহতের তালিকা আমরা প্রকাশ করতে রাজি নই। আন্দোলনে যেসব ছাত্র-জনতা মারা গেছেন, তাদের আমাদের ভাই হিসাবেই দেখছি। এজন্য এটাকে দলীয়ভাবে দেখছি না। আমরা আন্দোলনের সময় একই ব্যানারে ছিলাম, এজন্য আমি মনে করি সবার প্রতি আমাদের নৈতিক দায়িত্ব আছে।