গোমতীর বাঁধ ভেঙে প্লাবন, বেপরোয়া মাটি সিন্ডিকেটে দুর্বল হয়ে পড়ে বাঁধটি

প্রকাশিতঃ অগাস্ট ২৮, ২০২৪ | ৮:৪৪ পূর্বাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

মাটি সিন্ডিকেটের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে কুমিল্লার গোমতী নদীর বাঁধটি যে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছিল, সেটি ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছিল বেশ কিছু দিন ধরেই। বানের পানির তোরে বাঁধ ভেঙে শেষ পর্যন্ত স্থানীয়দের সেই শঙ্কাই সত্যি হলো। এ প্রসঙ্গটি এখন বৃহত্তর কুমিল্লার সর্বত্রই আলোচিত হচ্ছে। বলা হচ্ছে, প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় বেদখল আর শক্তিশালী মাটি সিন্ডিকেটের কারণে বাঁধের আরও বেশকিছু জায়গা ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। স্থানীয়দের দাবি, ১৫ বছর ধরেই বাঁধের ওপর অত্যাচার চলছিল। আওয়ামী লীগের স্থানীয় সংসদ-সদস্য এবং নেতাকর্মীদের মদদে গোমতী নদী এবং বাঁধ দখল করে নিজেদের মতো করে যাচ্ছেতাইভাবে ব্যবহার করা হচ্ছিল। স্থানীয় প্রশাসন এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারাও সিন্ডিকেটের সঙ্গে মিশে গেছেন। তারা কেবল নিজেদের পকেট ভারী করেছেন আর সবকিছুতেই নীরব সমর্থন দিয়ে গেছেন। গোমতীর মাটি এবং বালু লুটের জন্য প্রতিটি উপজেলায় পৃথক পৃথক পাঁচ থেকে সাতটি করে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। মাটি লুটের সময় প্রতিদিন শত শত ট্র্যাক্টর এবং ডাম্প ট্রাক বেড়িবাঁধ দিয়ে চলাচলের কারণে গোমতীর দুই পাড়ের বাঁধ অনেকটাই বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। তাছাড়া কোনো ধরনের অনুমতি ছাড়াই যত্রতত্র ঝুঁকিপূর্ণ ডাইভারশন এবং ড্রেজারের পাইপলাইন স্থাপনে বাঁধ ছিদ্র পর্যন্ত করা হয়েছে। এতে বাঁধটি কার্যত জরাজীর্ণ হয়ে যায়। কুমিল্লা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোসাব্বের হোসেন রাজীব বলেন, গোমতীর বেড়িবাঁধ জরাজীর্ণের নেপথ্যে মাটিখেকো সিন্ডিকেট। অবৈধভাবে ডাম্প ট্রাক, ট্রাক্টরসহ ভারী যানবাহন চলাচলের কারণে বাঁধটি দুর্বল হয়ে পড়েছে। এতে বাঁধের ক্ষতিসাধনসহ পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। আমরা অসংখ্যবার অভিযান পরিচালনা করেও তাদের সঙ্গে কুলাতে পারিনি। গোমতী নদী রক্ষা আন্দোলন কমিটির আহ্বায়ক সাদিক হোসেন মামুন বলেন, ত্রিপুরা থেকে যে পরিমাণ পানি এসেছে, তা ধারণের সক্ষমতা ছিল গোমতী নদীর। কিন্তু বাঁধের নাজুক অবস্থার কারণে তা সম্ভব হয়নি। বাঁধ দিয়ে মাটিবাহী ট্রাক, ট্রাক্টর, ডাম্প ট্রাক, ভেকুসহ নানা ধরনের যানবাহন চলাচল এবং যত্রতত্র ডাইভারশন করার কারণে বাঁধ দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাছাড়া ড্রেজার সিন্ডিকেটগুলো অসংখ্য জায়গা দিয়ে বাঁধ ছিদ্র করে পাইপলাইন নিয়েছে। এতে গোমতী বাঁধের পানি ধারণক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। জানা যায়, গোমতী বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃনদী। যার উৎপত্তি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের অরণ্যে ঘেরা পাহাড়ি অঞ্চল এবং গোমতী জেলার বিশাল জলাধার থেকে। নদীটি কুমিল্লার আদর্শ সদর, বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়া, দেবিদ্বার, মুরাদনগর, তিতাস ও দাউদকান্দি উপজেলার বুক চিড়ে মেঘনায় পতিত হচ্ছে। নদীর দুপাশে দুটি শক্তিশালী বাঁধ রয়েছে। সম্প্রতি গোমতী নদীর উৎপত্তিস্থল ত্রিপুরায় অতিবর্ষণে বন্যা হয়েছে। ওই এলাকার ডম্বুর বাঁধ দিয়ে গোমতী নদীতে হঠাৎ পানির ঢল নামে। এতে নদীর দুপাড়ের বাঁধের ৫০-৬০টি স্পট দিয়ে ভাঙনের উপদ্রব দেখা দেয়। নদী থেকে মাটি বহনকারী সিন্ডিকেটগুলোর করা ক্ষত, ডাইভারশন এবং ড্রেজারের পাইপলাইনের ছিদ্রগুলো দিয়ে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করতে থাকে। পরে ২২ আগস্ট রাতে জেলার বুড়িচং উপজেলার বুড়বুড়িয়া এলাকার একটি জরাজীর্ণ স্থান দিয়ে বাঁধ ভেঙে প্রায় ৪টি উপজেলার ৫ শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়। স্থানীয়রা জানান, মাটি সিন্ডিকেটগুলো প্রশাসন এবং সরকার দলের নেতাকর্মীদের ভাগবাঁটোয়ারা দিয়ে যুগ যুগ গোমতী নদীর ওপর দখলদারি বজায় রেখেছে। দীর্ঘ বছর বাঁধের ওপর দিয়ে মাটি বহনকারী শত শত ভারী যানবাহন চলাচল করে আসছে। সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গোমতীর মাটির সিন্ডিকেটের সদস্যরা বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে ভিড়েছে। অর্থাৎ সরকার বদল হলেও নানা কৌশলে বহাল তবিয়তে মাটি সিন্ডিকেটের সদস্যরা। শুষ্ক মৌসুমে জেলার আদর্শ সদর উপজেলার আলেখারচর, আমতলী, পালপাড়া, বানাসুয়া, ভাটপাড়া, চাঁনপুর, আড়াইওড়া, শ্রীপুর, মাঝিগাছা, পশ্চিম বিষ্ণপুর, দক্ষিণ রসুলপুর, ছত্রখিলসহ শতাধিক স্পট থেকে মাটি ও বালুবোঝায় শত শত ভারী যানবাহন চলাচল করে আসছে। জেলার বুড়িচং, দেবিদ্বার, মুরাদনগর , তিতাস ও দাউদকান্দি এলাকায় রয়েছে আরও দুই শতাধিক মাটি কাটার স্পট। প্রতিটি এলাকায় রয়েছে পৃথক সিন্ডিকেট। জেলার আদর্শ সদর উপজেলার বানাসুয়া এলাকার বাসিন্দা আব্দুল হাকিম বলেন, মাটি সিন্ডিকেটের ট্রাক্টর, ডাম্প ট্রাক চলাচলের কারণেই বাঁধের এমন নাজুক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। জেলার দেবিদ্বার উপজেলার খলিলপুর এলাকার বাসিন্দা খোয়াজ উদ্দিন বলেন, মাটি সিন্ডিকেটের সদস্যরা তাদের ইচ্ছামতো বেড়িবাঁধকে ব্যবহার করছে এবং যেখানে-সেখানে ডাইভারশন তৈরি করে বাঁধকে ঝুঁকিপূর্ণ করে দিয়েছে। এসব মাটিখেকোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি। জেলার মুরাদনগর উপজেলার দক্ষিণ ত্রিশ গ্রামের বাসিন্দা হোসেন মিয়া বলেন, আমরা মাটি সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছি। তারা প্রশাসন, এমপি এবং সব নেতাকে ম্যানেজ করেই এ অপকর্ম করছে। আমরা ভয়ে কখনো মুখ খুলিনি। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তারা খোলস বদলে ফেলেছে। এখন দেখছি মাটি সিন্ডিকেটের এসব সদস্য বিএনপির বিভিন্ন সভা-সমাবেশেও যাচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জামান বলেন, জনবল সংকটে আমরা মাটি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ নিতে পারি না। স্থানীয় প্রশাসনের ওপর নির্ভর করে যতটুকু সম্ভব ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। আমরা কোনোভাবেই তাদের প্রশ্রয় দিতে চাই না। জেলা প্রশাসক খন্দকার মুহাম্মদ মুশফিকুর রহমান বলেন, ট্রাক্টর, ভেকুসহ বিভিন্ন ভারী যানবাহন চলাচলের কারণে গোমতীর বেড়িবাঁধের অনেক ক্ষতি হয়েছে সত্য। আমরা নিয়মিত অভিযানের মাধ্যমে চেষ্টা করেছি তাদের দমন করার জন্য। আমরা তাদের বিরুদ্ধে অনেক আইনগত পদক্ষেপও নিয়েছি। কিন্তু রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সদিচ্ছা না থাকায় আমরা তাদের পুরোপুরি দমন করতে পারিনি।