দখল-বেদখলে সিদ্ধহস্ত ছিলেন হাছান মাহমুদ

প্রকাশিতঃ সেপ্টেম্বর ৩, ২০২৪ | ৯:২২ পূর্বাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ ১৫ বছরে হাসিনা সরকারের বিভিন্ন মেয়াদে প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রী হিসাবে দলে যেমন তার প্রভাব ছিল, তেমনই দায়িত্ব পালন করা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে প্রভাব খাটিয়ে দখল-বেদখল, অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে হাতিয়েছেন শত শত কোটি টাকা। নির্বাচনি হলফনামায় আয়-ব্যয় বা স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির হিসাব দেখে যে কেউ ভাববে তার চেয়ে সৎ, গরিব কোনো মন্ত্রী-এমপি বাংলাদেশে নেই। কিন্তু বাস্তবে নামে-বেনামে তার রয়েছে সম্পদের পাহাড়। বন ও পরিবেশমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে নিজে দখল করেছেন শত শত একর বনভূমি। যেখানে তিনি গড়ে তুলেছেন পর্যটনকেন্দ্রসহ নানা বিলাসী প্রকল্প। দখল করেছেন জাহাজ নির্মাণকারী ডকইয়ার্ড। দখলের ক্ষেত্রে তিনি ব্যবহার করেছেন নিজের ভাইদের। স্ত্রীর নামে নিয়েছেন শিপ হ্যান্ডলিং লাইসেন্স। হয়েছেন ফিশিং ট্রলারের মালিক। এরই মধ্যে এক ডকইয়ার্ড মালিক তার কাছে ৬০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছেন। করেছেন সংবাদ সম্মেলন। রাঙ্গুনিয়ায় অভিযান চালিয়ে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় উদ্ধার করেছে তার দখলে থাকা ২০০ একরেরও বেশি বনভূমি। তার নির্বাচনি এলাকা রাঙ্গুনিয়ায় বিরোধী দল বিএনপি-জামায়াত তো দূরের কথা, দলীয় লোকজন যারা তার মতের বাইরে ছিলেন, তারাও হয়েছেন নির্যাতিত। ১৫ বছরে সর্বক্ষেত্রে ত্রাসের রাজত্ব থাকলেও তার বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীদের কেউ মুখ খোলার সাহস করেননি। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এখন সরকারি সংস্থাগুলো যেমন সরব হয়েছে; তেমনই নানা ব্যক্তি-কোম্পানি যারা তার কারণে হয়রানি ও বঞ্চনার শিকার হয়েছে, তারাও প্রকাশ্যে এসেছে। সরকার পতনের পরদিন হাছান মাহমুদ বিদেশে পালানোর সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়েছেন বলে জানা গিয়েছিল। তবে তিনি এরই মধ্যে দেশ ছেড়ে পালিয়ে বেলজিয়াম চলে গেছেন বলেও খবর চাউর হয়েছে। বেলজিয়ামে পালানোর পর রোববার সরকারের পক্ষ থেকে তার বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা এসেছে। হাছান মাহমুদ আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত চার মেয়াদে রাঙ্গুনিয়া থেকে এমপি নির্বাচিত হন। প্রথম মেয়াদে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তৃতীয় মেয়াদে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী এবং চতুর্থ মেয়াদে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পান। আওয়ামী লীগের সর্বশেষ জাতীয় সম্মেলনে তাকে দলের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক করা হয়। দলে এবং মন্ত্রণালয়ে তার প্রভাব ছিল অপ্রতিরোধ্য। ২১২ একর বনবভূমি দখল : নির্বাচনি এলাকা রাঙ্গুনিয়ার খুরুশিয়া রেঞ্জে হাছান মাহমুদের ছোট ভাই এরশাদ মাহমুদ বন বিভাগের প্রায় ২১২ একর জমি দখল করেন। ২০০৯ সাল থেকে দখল করা এসব বনভূমিতে তিনি গড়ে তোলেন মহিষের খামার, পুকুর, বাগান, রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন স্থাপনা। সরকার পতনের পর কয়েক দফায় অভিযান চালিয়ে বন বিভাগ এসব জমি উদ্ধার করে। চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলাম বন বিভাগের বেদখল হওয়া জমি হাছান মাহমুদের পরিবারের কবল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেন। যদিও এরশাদ মাহমুদ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে দাবি করেছেন, সরকার থেকে লিজ নিয়েই বনের জমিতে তারা খামার গড়ে তুলেছিলেন। ডকইয়ার্ড দখল, ৬০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূণ চেয়ে লিগ্যাল নোটিশ : ২০২১ সালের মার্চে চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তীরে এফএমসি নামে একটি ডকইয়ার্ড দখলের অভিযোগ উঠে হাছান মাহমুদের বিরুদ্ধে। তার পক্ষে ভাই খালেদ মাহমুদ সরাসরি গিয়ে সিকিউরিটিকে মারধর করে এই ডকইয়ার্ড দখল করে নেন। সিকিউরিটিকে মারধরের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। হাছান মাহমুদের স্ত্রী নুরান ফাতেমার নামে সৃষ্ট একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এফএমসির চুক্তি, ফিশিং ট্রলার নির্মাণের চুক্তিসহ বিভিন্ন দলিল সৃষ্টি করা হয়। ব্যাংক ঋণের বিশাল বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয় এফএমসির নামে। হাছান মাহমুদ মন্ত্রী থাকার কারণে তার অনেক অন্যায় আবদার মেনে নিতে হয়েছে বলে দাবি করেন এফএমসি ডকইয়ার্ডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইয়াসিন চৌধুরী। সরকার পতনের পর রোববার সংবাদ সম্মেলন করে প্রকাশ্যে তার ডকইয়ার্ড দখলের বিষয়টি সামনে আনেন। একই সঙ্গে ৬০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করে হাছান মাহমুদ ও তার স্ত্রীর নামে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন বলেও জানান ইয়াছিন চৌধুরী। ক্ষমতার অপব্যবহার করে তারা প্রশাসনিক হয়রানিসহ নানাভাবে এফএমসি ডকইয়ার্ড লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও তার প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের ৬০০ কোটি টাকা ক্ষতিসাধন করেছেন বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়। জানা যায়, সর্বশেষ চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বন্দরের বহির্নোঙরে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর নিয়োগের জন্য ২৩টি লাইসেন্স প্রদান করে। কোনো ধরনের নিয়মনীতি ও আদালতের আদেশ-নিষেধের তোয়াক্কা না করে মন্ত্রী, এমপি, আওয়ামী লীগ নেতাদের এসব লাইসেন্স দেওয়া হয়। এর মধ্যে একটি লাইসেন্স বাগিয়ে নেওয়া হয় হাছান মাহমুদের স্ত্রী নুরান ফাতেমার নামে। চাপ দিয়ে নেওয়া হয়েছিল ৪১ কোটি টাকার প্রকল্প : হাছান মাহমুদের সুপারিশ ও চাপে নিজ নির্বাচনি এলাকা চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ ‘সাইট অ্যান্ড সার্ভিসেস আবাসিক প্লট উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। ২০১৪ সালে এ প্রকল্পের জন্য হাছান মাহমুদ ডিও লেটার দেন। তবে এটি বাস্তবায়নে আপত্তি করেছিল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তর। রাঙ্গুনিয়ার ইছাখালীতে প্রকল্প এলাকার ৭০ শতাংশ পাহাড় এবং ৩০ শতাংশ জলাধার থাকায় বিভিন্ন সংস্থার আপত্তিতে প্রকল্পটি বাতিল করা হলেও ২০২০ সালের মার্চে প্রকল্পটি অনুমোদন হয়। মন্ত্রী অনেকটা চাপ দিয়েই এ প্রকল্প অনুমোদন করান বলে অভিযোগ আছে। ১৬ দশমিক ১৯ একর জমি ধরা হলেও ১৪ দশমিক ১৯ একরে বাস্তবায়ন করতে বলা হয়। এতে ব্যয় ধরা হয় ৪১ কোটি ৮৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এর মধ্যে ৩৮ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয় ভূমি অধিগ্রহণে। তবে অযৌক্তিক ও টাকা হাতানোর এ প্রকল্পের পরিবেশ ছাড়পত্র অবশেষে বাতিল করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। প্রকল্প কর্মকর্তা জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের চট্টগ্রামের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী নেজামুল হক মজুমদার বলেন, প্রকল্পটি রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ইছাখালী এলাকায় বাস্তবায়ন করার কথা ছিল। এ প্রকল্পে তাদের মতামত ছিল না। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে এ প্রকল্প নেওয়া হয়। এখন প্রকল্পটি বাতিল করা হয়েছে। হলফনামায় গরিব, বাস্তবে বিপুল বিত্তের মালিক : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৭ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসাবে হলফনামা জমা দেন হাছান মাহমুদ। এতে তার ২ কোটি ২৮ লাখ টাকা ঋণ রয়েছে বলে উল্লেখ করেন। সংসদ-সদস্য ও মন্ত্রী হিসাবে প্রাপ্ত ভাতা বাদে কৃষি খাতসহ বিভিন্ন খাত থেকে তার বার্ষিক আয় দেখানো হয় ২ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। ২০ লক্ষাধিক টাকার অস্থায়ী সম্পদ এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে মাত্র ১২ লাখ টাকা জমা দেখানো হয়। ভাইদের কাছ থেকেও ১২ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন বলে তিনি হলফনামায় উল্লেখ করেছিলেন। বিয়ের সময় পাওয়া নিজ নামে ৫ ভরি ও স্ত্রীর নামে ৫০ তোলা স্বর্ণ রয়েছে। তবে তার চেয়েও তার স্ত্রী একজন ব্যবসায়ী এবং আর্থিকভাবে ধনী বলে উল্লেখ করা হয়। হলফনামায় নুরান ফাতেমার স্থায়ী ও অস্থায়ী সম্পদ দেখানো হয়েছে ১০ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। ড. হাছান মাহমুদ নগরীর সিরাজউদদৌলা রোডে আকাশচুম্বী একটি ভবন নির্মাণ করেছেন। চৌধুরী টাওয়ার নামে পরিচিত এটি। এই একটি ভবনেই তার বিনিয়োগ শতকোটি টাকা বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও এ ভবনটি তার শ্বশুরপক্ষের বলে দাবি করা হয়। চট্টগ্রামের অনন্যা আবাসিক এলাকা, দেওয়ান বাজার মৌসুমি মোড়সহ বিভিন্ন স্থানে রয়েছে কোটি কোটি টাকার প্লট, ফ্ল্যাট ও বাড়ি। বিদেশেও তার সম্পদ রয়েছে বলে চাউর আছে। সরকার পতনের দিন সিরাজউদদৌলা রোড ও মৌসুমি মোড়ের ভবন দুটিতে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করে বিক্ষুব্ধ জনতা। সূত্র জানায়, বিএনপিসহ বিরোধী দলের কার্যক্রম নিয়ে সব সময় ব্যাঙ্গাত্মক ও বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য করতেন ড. হাছান মাহমুদ। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে থাকাকালে সাংবাদিকতার মর্যাদাকে ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে যাচাই-বাছাই না করে তিনি অগণিত অনলাইন পোর্টাল ও আন্ডারগ্রাউন্ড টিভি, প্রিন্ট মিডিয়ার অনুমোদন দেন। ভুঁইফোঁড়, অনলাইন, ভুয়া সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা কখনোই নেননি। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবসহ বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন লিখিত ও মৌখিকভাবে তাকে এ বিষয়ে দাবি জানালেও তিনি ছিলেন নীরব। উলটো গাধা-ঘোড়া এক করতে তিনি অপসাংবাদিকতাকে নানাভাবে উসকে দিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।