অপকর্মের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ বিএনপির

প্রকাশিতঃ সেপ্টেম্বর ৭, ২০২৪ | ৭:১০ পূর্বাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সারা দেশে শুরু হয় নৈরাজ্য ও সহিংসতা। যে কোনো মূল্যে দেশে সম্প্রীতি রক্ষা, লুটপাট, চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব বন্ধসহ শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে বিএনপি। দল কিংবা দলের নাম ব্যবহার করে অপকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে এরই মধ্যে সারা দেশে বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের দুই শতাধিক নেতাকর্মীকে বহিষ্কার কিংবা পদ স্থগিত করা হয়েছে। এছাড়া অনেককে শোকজ করা হয়েছে। এ তালিকায় গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় নেতারাও রয়েছেন। এর ফলে পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে বলে দাবি দলটির। তবে হাইকমান্ডের শতভাগ আন্তরিকতা এবং দলের কঠোর অবস্থান সত্ত্বেও কিছু নেতাকর্মীর নেতিবাচক কর্মকাণ্ড পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। এ কারণে ‘উচ্ছৃঙ্খল’ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে এবার সাংগঠনিক ব্যবস্থার পাশাপাশি আইনি পদক্ষেপও নিতে শুরু করেছে দলটি। ইতোমধ্যে দলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় অন্তত দশটি এজাহারও দায়ের করা হয়েছে। এদিকে বিভিন্ন কারখানা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানে নাশকতা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল। ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিনিধি, শ্রমিকদল ও ২১টি শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধি নিয়ে শ্রমিক ব্রিগেড গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য। বর্তমান পরিস্থিতিতে সম্প্রতি দশ সাংগঠনিক বিভাগের তৃণমূল নেতাকর্মীদের নিয়ে ধারাবাহিক মতবিনিময় (ভার্চুয়ালি) সভা করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। যা বুধবার শেষ হয়। এতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দলের অবস্থান ও দেশ নিয়ে তার ভাবনার পাশাপাশি নানা দিকনির্দেশনা দেন। তিনি স্পষ্ট বার্তা দিয়ে বলেন, শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের দেশপ্রেম, দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার ত্যাগ আর শত সহস্র নেতাকর্মীর আত্মত্যাগের বিনিময়ে বিএনপি জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসের যে জায়গায় পৌঁছেছে, কতিপয় বিপথগামীর হঠকারিতায় তা বিনষ্ট হতে দেওয়া হবে না। এ বিষয়ে দল আপসহীন, তিনি দলের কত শীর্ষে অবস্থান করেন সেটা বিবেচ্য নয়। এ সময় সম্প্রতি চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহে অপকর্মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থার কথা নেতাকর্মীদের স্মরণ করিয়ে দেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। জানতে চাইলে বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী সাইয়েদুল আলম বাবুল বলেন, ঢাকা বিভাগের সভায় প্রায় ১৩ হাজার নেতা অংশ নেন। এতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নানা দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। যারা দুষ্কর্ম করার চেষ্টা করবে, তাদের প্রতিহত করতে বলেছেন। যেসব নেতাকর্মী দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করবে, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়েও কঠোর নির্দেশনা দেন। এদিকে বিভিন্ন কলকারখানা ভাঙচুর, নৈরাজ্য ও শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টিকারী ও ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে শ্রমিক দল। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী এবং জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল ও সম্মিলিত শ্রমিক পরিষদের প্রধান সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস বলেন, তারা ইতোমধ্যে বিভিন্ন জেলায় মতবিনিময় সভা শুরু করেছেন। বৃহস্পতিবার গাজীপুরে সভা করেছেন। বন্দর, গার্মেন্ট, ঔষধ কারখানা, সড়ক পরিবহণ, সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন অফিস-আদালতে ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানে নাশকতা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসাবে শুক্রবারও জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তন ও নারায়ণগঞ্জের আদমজি ইপিজেড মাঠে ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিনিধি, শ্রমিকদল ও ২১টি শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধি সভা হয়। এতে ‘শ্রমিক ব্রিগেড’ গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভায় জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে পরাজিত ফ্যাসিস্ট ও তাদের দোসরদের প্রতিবিপ্লব সৃষ্টির অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সাধারণ শ্রমিকদের সম্পৃক্ত করে মাঠপর্যায়ে চাঁদাবাজ, দখলদার ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রত্যয় ঘোষণা করা হয়। তিনি আশা করেন, বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রাখার জন্য কারখানা ও প্রতিষ্ঠানভিত্তিক শ্রমিক ব্রিগেড গঠন করে শিল্প কলকারখানায় উৎপাদন স্বাভাবিক রাখা ও শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা সম্ভব হবে। জানা গেছে, দল কিংবা দলের নাম ব্যবহার করে চাঁদাবাজি-দখলদারিসহ নানা অপকর্মে জড়িতদের বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে বিশেষ সেলও গঠন করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তদন্ত সাপেক্ষে সেলের সদস্যদের রিপোর্টের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন তিনি। সম্প্রতি ময়মনসিংহে বিএনপির এক নেতার বিরুদ্ধে দলের পক্ষ থেকে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়। বিএনপির নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অনৈতিক সুবিধা আদায়ের অভিযোগে ময়মনসিংহ দক্ষিণ জেলা শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক ও ভালুকা উপজেলা শাখার আহ্বায়ক ফখরুদ্দিন আহমেদ বাচ্চুকে প্রথমে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর সোমবার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশে দলের পক্ষে যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স ভালুকা থানায় বাচ্চুসহ অজ্ঞাতপরিচয় ১৫ থেকে ২০ জনের বিরুদ্ধে লিখিত এজাহার দায়ের করেন। এছাড়া একই কারণে জয়পুরহাটে ও রাজধানীর পল্টন, রমনা ও কলাবাগান থানায়ও দল ও সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে এজাহার দায়ের করা হয়েছে বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের পক্ষ থেকে। দলটির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে, তাদের মধ্যে পদধারী নেতা খুবই কম। বেশিরভাগই হাইব্রিড এবং দলে অনুপ্রবেশকারী। যারা এতদিন দলের দুর্দিনে পাশে ছিল না, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারাই রাতারাতি দলের নাম ভাঙিয়ে অপকর্মে জড়িয়ে বিএনপির ভাবমূর্তি-সুনাম ক্ষুণ্ন করছে। এসব ব্যাপারে সারা দেশে দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে কেউ যদি কোথাও দলের নাম ভাঙিয়ে অপকর্ম করে, তাকে ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তুলে দেওয়া এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের জানাতে বলা হয়েছে। অপকর্ম করে এখনো অধরা কিছু নেতা : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখনও বিভিন্ন জেলায় চাঁদাবাজি, লুটের মতো ঘটনা ঘটছে। তবে আগের চেয়ে অনেক কম। চাঁদা দিতে রাজি না হলে হত্যা মামলার আসামি করারও ঘটনা ঘটছে। এমনকি জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তরে আবেদন করা হলেও অদৃশ্য কারণে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না বলে কয়েকজন স্থানীয় পর্যায়ের নেতা অভিযোগ করেছেন। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে নানা অপকর্মের ফিরিস্তি জানিয়ে দপ্তরে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানালেও কোনো প্রতিকার পাননি সেখানকার ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ। ওই নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে আড়াইহাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে, এমনকি থানায়ও। ওই নেতার রোষানলে পড়েছে বৃহৎ রপ্তানিমুখী পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ফকির গ্রুপও। এ গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ৫০ হাজারের মতো কর্মী রয়েছেন। ফকির ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির কামরুজ্জামান নাহিদ বলেন, ‘আমরা ব্যবসায়ী। আমাদের পরিবার কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম আজাদ প্রতিটি গার্মেন্ট থেকে চাঁদা চেয়েছেন। না দেওয়ার কারণে ব্যবসায়িক সুনাম ক্ষুণ্ন ও হয়রানি করার উদ্দেশ্যে আমাদের ফকির নিটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির আক্তারুজ্জামান ও উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির মাশরিকুজ্জামান নিয়াজ এবং আমাকে দুটি হত্যা মামলায় আসামি করেছেন। সবাইকে ভয় দেখিয়ে রেখেছেন, এমপি হলে কারখানা চালাতে দেবেন না। নানা ধরনের হুমকি-ধমকি দিয়ে রেখেছেন। চাঁদাবাজি, লুটতরাজসহ মিথ্যা মামলায় হয়রানির বিষয়ে আমরা ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, বিজিএমইএ, বিকেএমইএসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানের কাছে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চিঠি দিয়েছি। চলতি সপ্তাহে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার কাছেও দেওয়া হবে।’ আড়াইহাজারের কালাপাহারিয়া ইউনিয়নে সরকারি সফর আলী কলেজের সাবেক এজিএস ও আড়াইহাজার থানা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক আবু হানিফ বলেন, ‘১৩ আগস্ট আমাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়েছে আজাদের লোকজন। ডান হাতের চারটি রগ কেটে ফেলেছে। চাইনিজ কুড়াল দিয়ে বাম হাতে আটটি কোপ দিয়েছে। আজাদের নির্দেশে এই হামলা হয়। নিজ দলের লোকজন হামলা করবে কখনো ভাবিনি। অথচ বিস্তারিত বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তরে চিঠি দিয়ে জানালেও এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিকার পাইনি।’ এদিকে গাজীপুরে তৈরি পোশাক কারখানার ঝুটসহ বিভিন্ন পরিত্যক্ত মালামালের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে বিএনপি নেতাদের নাম এলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না বলে ওই জেলার একাধিক নেতা জানিয়েছেন। পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলা বিএনপির আহ্বায়কের বিরুদ্ধে নানা অপকর্মের অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে দলের পক্ষ থেকে তাকে শোকজ করলেও থেমে নেই তার অপকর্ম। এ নিয়ে ভুক্তভোগীরা সংবাদ সম্মেলনও করেছেন। কেন্দ্রীয় দপ্তরে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চিঠিও দিয়েছেন। এ রকম আরও বিভিন্ন জেলার কিছু নেতার বিরুদ্ধে এখনও চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া গেলেও ভয়ে কেউ কথা বলতে সাহস পাচ্ছেন না। জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘অপকর্মের সঙ্গে জড়িত, দলের ভাবমূর্তি বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে এখন শুধু সাংগঠনিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নয়, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। নেতাকর্মীদের ১৫ বছরের আত্মত্যাগ এবং কমিটমেন্ট কিছু ব্যক্তির অপকর্মের জন্য প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে না। তাদের দায় দল নেবে না।’