স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতি বলতে আমরা বুঝি স্বাস্থ্যসেবা, স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য গবেষণা এ তিনটির উন্নতি। উন্নয়ন, মূল্যায়ন, আধুনিকায়ন, মনিটরিং ও জবাবদিহিতা-এই পাঁচটি হলো স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতির চাবিকাঠি। ২৫ আগস্ট মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া তার ভাষণে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে যা বলেছেন তার সারসংক্ষেপ হলো : ১. বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত খাত। ২. জনগণের জন্য পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে। ৩. এ খাতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনা হবে। ৪. হাসপাতালগুলোর আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে। ৫. সেখানে সরকারি ডাক্তারসহ বিশেষজ্ঞদের নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করা হবে এবং ৬. স্বাস্থ্যসেবা যাতে নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত না থেকে দেশের সব অঞ্চলের মানুষ সমান স্বাস্থ্যসেবা পায়, সে লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে সরকার বদ্ধপরিকর। আমি ৬ নং থেকে শুরু করছি। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন সমগ্র দেশে স্বাস্থ্যসেবার অভিন্ন বিতরণের কথা। এ অভিন্ন বিতরণের জন্য আমি একটি রূপকল্প (২০২৪ থেকে ২০৩০ সাল) তুলে ধরতে চাই। সরকারি পর্যায়ে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার কাঠামো-প্রথম : ইউনিয়ন পর্যায়ে-ইউনিয়ন সাব সেন্টার, কমিউনিটি ক্লিনিক, পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র। দ্বিতীয় : উপজেলা পর্যায়ে-উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স (স্বাস্থ্যসেবা এবং পরিবার পরিকল্পনা)। তৃতীয় : জেলা পর্যায়ে-জেলা সদর হাসপাতাল। চতুর্থ : মেডিকেল কলেজ, ইনস্টিটিউট এবং মেডিকেল ইউনিভার্সিটি। এবার দেখা যাক উপজেলা পর্যায়ে কীভাবে স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়ন করা যায়। ১. প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আধুনিকায়ন প্রয়োজন। ২. তিন থেকে পাঁচটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মধ্যে একটিকে আদর্শ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রূপান্তর করা প্রয়োজন। আদর্শ কমপ্লেক্সের রূপরেখা কমপ্লেক্সের পরিসর বৃদ্ধিকরণ : আদর্শ কমপ্লেক্সগুলোকে ২৫০ বেডের হাসপাতালে পরিণত করতে হবে। ওই হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, মেডিকেল অফিসার, নার্সিং স্টাফ এবং অধস্তন কর্মচারীর সংখ্যা বাড়াতে হবে। লজিস্টিক জনশক্তি দিতে হবে (প্যাথলজি, রেডিওলজি ও সনোলজি জনশক্তি)। ডায়াগনস্টিক (ইনভেসটিগেশন) ফ্যাসিলিটি বাড়াতে হবে। উপযুক্ত অপারেশন থিয়েটার, পোস্ট অপারেটিভ রুম এবং সিসিইউ থাকতে হবে। চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও স্টাফদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। ২৪ ঘণ্টা সার্ভিস দেওয়ার জন্য কমপক্ষে তিনটি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা থাকতে হবে। বিশেষায়িত চিকিৎসাব্যবস্থা থাকতে হবে। বিশেষায়িত চিকিৎসাব্যবস্থার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, শিশু বিশেষজ্ঞ, গাইনি বিশেষজ্ঞ, হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, বিশেষজ্ঞ জেনারেল সার্জন, বিশেষজ্ঞ অর্থোপেডিক সার্জন, চর্ম ও যৌন বিশেষজ্ঞ, চক্ষু বিশেষজ্ঞ, নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ, মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ। অপারেশনের জন্য যা যা দরকার, সেভাবে কমপ্লেক্সটিকে সাজাতে হবে। যেমন-অপারেশন থিয়েটার, পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ড, প্রয়োজনীয় এনেসথেটিস্টস, প্রয়োজনীয় মেডিকেল অফিসার, এক্সপার্ট নার্সিং স্টাফ এবং অন্যান্য জনশক্তি। হৃদরোগের জন্য আইসিইউ এবং তার লজিস্টিক সাপোর্ট। ডাক্তারসহ হাসপাতালের স্টাফদের জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা। দক্ষ ও কার্যকর হাসপাতাল প্রশাসন। Non communicable disease-এর জন্য counseling and prevention centre. চিকিৎসক এবং অন্য স্টাফদের যথাযথ মূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকতে হবে। আদর্শ কমপ্লেক্স সেবা দেওয়ার পদ্ধতি-১. আউটডোর সিস্টেম, ২. ইমার্জেন্সি সিস্টেম ও ৩. ইনডোর সিস্টেম। আউটডোর সিস্টেম : ক. প্রতিদিন ৮টা থেকে ২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত আউটডোর খোলা থাকবে। খ. আউটডোরে পর্যাপ্ত মেডিকেল অফিসার ও কনসালটেন্টদের চেম্বার থাকবে। গ. বিভাগ অনুযায়ী আউটডোর সার্ভিস দিতে হবে, যেমন-মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি ইত্যাদি। ঘ. আউটডোরে প্রয়োজনীয় সব ধরনের ওষুধের প্রাপ্যতা থাকতে হবে। ইমার্জেন্সি সিস্টেম : ক. ২৪ ঘণ্টা ইমার্জেন্সি খোলা থাকবে। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ৩টা, দুপুর ৩টা থেকে রাত ১০টা এবং রাত ১০টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার রোস্টার আকারে দায়িত্ব পালন করবেন। খ. যারা ইমার্জেন্সি ডিউটি করবেন, তারা আউটডোর ডিউটি করবেন না। ইনডোর সিস্টেম : ক. ইনডোরের বেডগুলো মেডিসিন, পেডিয়াট্রিক, গাইনি, সার্জারি, হৃদরোগ এবং অন্যান্য হিসাবে বিভাজিত থাকবে। খ. কনসালটেন্টরা ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে ইনডোর রাউন্ড শেষ করে আউটডোরে যাবেন। গ. ইনডোর মেডিকেল অফিসাররা রোস্টার করে ইনডোর সেবা দিয়ে থাকবেন। ইনভেসটিগেশন সিস্টেম : প্রাথমিক সব ধরনের ইনভেসটিগেশন ফ্যাসিলিটি আধুনিক স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে থাকতে হবে। যেমন-১. ব্লাড হিমাটোগ্রাম, ২. পিবিএফ, ইএসআর, ৩. রেডিওলজিক্যাল ইনভেস্টিগেশন, ৪. ইউরিন রুটিন এক্সামিনেশন, ৫. ব্লাড বায়োকেমিস্ট্রি, ৬. আল্ট্রাসনোগ্রাফি, ৭. ইসিজি, ৮. ইকো। এগুলো হচ্ছে একটি আদর্শ, আধুনিক স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠার বিষয়। কিন্তু অন্যসব স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেরও এভাবে উন্নয়নের প্রয়োজন আছে, যদিও তা একটু কম পরিসরে। চিকিৎসকদের মূল্যায়ন সরকারি চিকিৎসকরা বিসিএসের (স্বাস্থ্য) মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে বিভিন্ন উপজেলায় পদায়িত হন। এর মাধ্যমে তাদের দীর্ঘ জীবনের চাকরির যাত্রা শুরু হয়। চাকরি চলাকালীন তাদের মাঝে কেউ কেউ আন্তরিক থাকেন, আবার কারও মাঝে আন্তরিকতার ঘাটতি দেখা যায়। কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় উপযুক্ত মনিটরিং সিস্টেম না থাকায় যারা আন্তরিক তারা যেমন মূল্যায়িত হন না, তেমনি যাদের মাঝে আন্তরিকতার ঘাটতি আছে তারাও অবমূল্যায়িত হন না। ফলে তাদের মাঝে উৎসাহ অথবা ভীতি কোনোটাই দেখা যায় না। যারা পোস্ট গ্র্যাজুয়েট করবে, তাদের অনেকেই এফসিপিএস অথবা এমডি প্রথম পর্ব পাশ করার পরও তাদের যথাযথ পোস্টিং দেওয়া হয় না। যিনি মেডিসিনে পার্ট ওয়ান পাশ করেছেন, দেখা যায় তাকে দেওয়া হয়েছে মেডিসিন ছাড়া অন্য কোনো বিভাগে। যিনি কাজে নিজের মেধা ও সময়কে উৎসর্গ করে দিয়েছেন, তাকেও দেখা যায়, এর চেয়েও আরও কম সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন জায়গায় পদায়ন করা হয়েছে। ফলে তার মাঝে হতাশা সৃষ্টি হয়। আমি এ মূল্যায়নের ব্যাপারটি চাকরির শুরুর ক্ষেত্রে বললাম। কিন্তু পরেও চিকিৎসকরা এভাবে অবমূল্যায়িত হয়ে থাকেন। অধ্যাপক ডা. মো. ফয়জুল ইসলাম চৌধুরী : সাবেক ইউনিট প্রধান, মেডিসিন বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল