সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা বৃদ্ধি খতিয়ে দেখা হচ্ছে

প্রকাশিতঃ সেপ্টেম্বর ৮, ২০২৪ | ৯:১৩ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেক্স

খতিয়ে দেখা হচ্ছে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরে ৬ হাজার ৫৭৩ কোটি ৯৬ লাখ টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব। প্রকল্প গ্রহণের প্রায় সাড়ে ৪ বছরের মাথায় কেন এত বিপুল পরিমাণ খরচ বাড়ানো হচ্ছে সেটি নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। এদিকে প্রকল্পের আওতায় এখনো মূল পূর্ত কাজই শুরু হয়নি। এ অবস্থায় ‘মাতারবাড়ী পোর্ট ডেভেলপমেন্ট’ প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাব ফেরত দেওয়া হয়েছে। অনুমোদনের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেওয়া হলেও এখন নতুন করে ব্যয় প্রস্তাব পর্যালোচনা করবে পরিকল্পনা কমিশন। সদ্য পতন হওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের শেষদিকে এটি সংশোধনের প্রক্রিয়া শেষ হয়। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরই দফায় দফায় এই ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন উঠে। ফলে ঢালাও অনুমোদন না দিয়ে প্রকৃতপক্ষে এত টাকার প্রয়োজন কিনা এবং কেন বাড়ছে সেসব নিয়ে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা বলেন, প্রকল্পটি গ্রহণের স্বল্প সময়ের মধ্যে একবার ব্যয় বাড়ানো হয়েছিল প্রায় ১০০ কোটি টাকা। এবার দ্বিতীয় দফায় বিপুল অঙ্কের টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়ায় এখানে কোনো ঘাপলা আছে কিনা সেটি আরও কঠোরভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যদিও এরই মধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে একনেকে (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি) অনুমোদনের সুপারিশ দিয়েছিল পরিকল্পনা কমিশন। কিন্তু এতে সন্তুষ্ট নয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আবারও নতুন করে পর্যালোচনা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তারা আরও বলেছেন, এক্ষেত্রে যেসব কম্পোনেন্ট প্রকৃতপক্ষেই প্রকল্পের জন্য অপরিহার্য সেসব দেখা হবে। পাশাপাশি কম গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম বাদ দেওয়া হতে পারে। বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ও শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য ড. জাহিদ হোসেন শনিবার বলেন, অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা দুজনেই এর আগে বলেছেন পুরো উন্নয়ন কর্মসূচিই পুনর্বিবেচনার সুযোগ রয়েছে। তবে গভীর সমুদ্রবন্দর দীর্ঘমেয়াদি এবং কারিগরি দিক থেকে জটিল প্রকল্প। এটির বাস্তবায়ন অত সোজা নয়। বর্তমান আর্থিক টানাপোড়েনের মধ্যে এত বড় প্রকল্প এই মুহূর্তে বাস্তবায়ন করার প্রয়োজন আছে কিনা সেটিও পর্যালোচনার দাবি রাখে। কেননা এই টাকা অন্য কোনো খাতে ব্যয় করে গভীর সমুদ্রবন্দরের চেয়ে বেশি সুফল এলে সেটিই করা জরুরি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ প্রকল্পটি রুটিন রিভিউ করলে কোনো লাভ হবে না। যেটি হবে তা হলো, ‘যে লাউ সেই কদু’। তাই বড় প্রকল্পসহ পুরো এডিপি নির্মোহ পর্যালোচনার জন্য তৃতীয় পক্ষের দরকার। যাদের এক্ষেত্রে কোনো স্বার্থ থাকবে না। তারা নিরপেক্ষ পর্যালোচনা করবে। জানা যায়, ‘মাতারবাড়ী পোর্ট ডেভেলপমেন্ট’ প্রকল্পটির মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) ঋণ ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা, সরকারি তহবিলের ২ হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব তহবিল থেকে ২ হাজার ২১৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা। কিন্তু এরই মধ্যে প্রকল্পটির প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে প্রায় শতকোটি টাকা ব্যয় বাড়িয়ে মোট ব্যয় করা হয় ১৭ হাজার ৮০৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এবার দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে ৬ হাজার ৫৭৩ কোটি ৯৬ লাখ টাকা বাড়িয়ে মোট ২৪ হাজার ৩৮১ কোটি ৪০ লাখ টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। সেই সঙ্গে প্রকল্পের মূল মেয়াদ ছিল ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। এখন নতুন করে ৩ বছর বাড়িয়ে ২০২৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়। প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধনীর কারণ প্রসঙ্গে প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, বন্দর কর্তৃপক্ষ অংশে শুধু ডলারের দাম বাড়ায় অতিরিক্ত খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে ১ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। এছাড়া সিডি ভ্যাট, পোর্ট চার্জ, ভূমি অধিগ্রহণ, কন্টিনজেন ফি, পরামর্শক ফিসহ রাজস্ব খাতে বেশকিছু অংশে ব্যয় বেড়েছে। এসব নানা কারণে বন্দর নির্মাণ অংশে ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে ২ হাজার ৪৬৩ কোটি ৯২ লাখ টাকা। এদিকে সড়ক ও জনপথ অংশে প্রাথমিকভাবে সড়ক ও মহাসড়ক নির্মাণের যে লক্ষ্য ছিল পরে সেটি ডিটেইল ডিজাইনে পরিবর্তন করা হয়। এক্ষেত্রে সড়ক নির্মাণের পরিমাণ কমে গিয়ে সেতু নির্মাণ কাজ বেড়ে যায়। ফলে এ অংশের ব্যয় বেড়েছে ৬৭৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এছাড়া মূল ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) তৈরি হয়েছিল ২০১৮ সালের সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের রেট শিডিউল অনুযায়ী। কিন্তু এখন হালনাগাদ ২০২২ সালের রেট শিডিউল ধরায় পূর্ত কাজের ব্যয় বাড়ছে ১ হাজার ৯১৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এখানে ডলারের দাম বাড়ায় বৃদ্ধি পাচ্ছে ৪৬১ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। আরও জানা যায়, রেট শিডিউল পরিবর্তন হওয়ায় নির্মাণ সাইট ‘বি’ ক্যাটাগরির হওয়ায় প্রতিটি আইটেমের রেটের ওপর ১০ শতাংশ অতিরিক্ত মূল্য হিসাবে ৯০৭ কোটি ৩৬ লাখ টাকা বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়া প্রকল্পের মেয়াদ ৩ বছর বেড়ে যাওয়ায় শুধু পরামর্শক খাতেই বাড়বে ৮৭ কোটি ২৯ লাখ টাকা। প্রকল্পের বাস্তবায়ন অবস্থা সম্পর্কে জানা যায়, মে মাস পর্যন্ত প্রকল্পের আওতায় ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় হয়েছে ৭১০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ। তবে প্রকল্পের মূল পূর্ত কাজ শুরু না হওয়ায় বাস্তব অগ্রগতি এখনো শূন্য শতাংশ। একনেক সভার জন্য তৈরি করা কার্যপত্রে মতামত দিয়েছেন পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সাবেক সদস্য ও বর্তমান কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়া। সেখানে তিনি বলেছেন, সংযোগ সড়কসহ কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ হলে মাদার ভেসেলগুলো সরাসরি বন্দরে নোঙ্গর করতে পারবে। ফলে কার্গো হ্যান্ডলিং ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া ভবিষ্যতে এই বন্দর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চাহিদা মেটানো এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে দ্রুত বন্দর সেবা দিতে পারবে। এসব দিক বিবেচনা করে পিইসি সভার সিদ্ধান্ত প্রতিপালন করায় একনেকে অনুমোদনের সুপারিশ করা হয়েছে।