নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে বিদ্যমান আইন ত্রুটিপূর্ণ এবং ওই আইনের মাধ্যমে দলীয় পক্ষপাতদুষ্ট কমিশনার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে দাবি করে তা বাতিল চেয়েছেন কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতা, নাগরিক সমাজ ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার তড়িঘড়ি করে ওই আইন প্রণয়ন করে। ওই আইনের মাধ্যমে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন গঠন করেছিল, তা ছিল দলীয় পক্ষপাতদুষ্ট। শনিবার রাজধানীর একটি হোটেলে ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল আয়োজিত ‘বাংলাদেশে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ’ বিষয়ে পলিসি ডায়ালগে বক্তারা এসব কথা বলেন। তারা প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে গ্রহণযোগ্য, সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিদের দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য নতুন আইন প্রণয়নের সুপারিশ করেন। নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নেওয়ার যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে তা সংশোধনের কথা বলেন। নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের আইনটি ২০২২ সালে পাশ করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। ওই আইনের অধীনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন গঠিত হয়। ওই কমিশন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করে। বিএনপিসহ প্রধান বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণ ছাড়া অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচন ‘আমি-ডামি নির্বাচন’ নামে খ্যাতি পায়। সংলাপে অন্তর্বর্তী সরকারের বস্ত্র ও পাট এবং নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নির্বাচন কমিশন নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনটি স্তর থাকতে পারে। প্রথম স্তরের কমিটিতে নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক দল থাকতে পারে। সেখানে নির্বাচন কমিশনার হিসাবে যাদের নাম আসবে তা বাছাই করে দ্বিতীয় স্তরের কমিটিতে যাবে। সেখানে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও সর্বশেষ প্রধান নির্বাচন কমিশনার ওই নাম বাছাই করে পরবর্তী ধাপের জন্য দেবেন। তৃতীয় ধাপে জাতীয় সংসদের (যদি সংসদ বহাল থাকে) বিজনেস কমিটি নাম চূড়ান্ত করবেন। এভাবে সবার মতামত নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলে তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তী সরকার ছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা থাকার সময় তার বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে জানিয়ে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, পুলিশকে মানবিক না করে দানব বানানো হয়েছে। তাদের হাতে ৭.৬২ এমএম রাইফেল দেওয়া হয়েছে, যা মারণাস্ত্র। ওই অস্ত্র পুলিশের কাছে দেওয়ার বিধান নেই। কারা পুলিশকে এই অস্ত্র দিয়েছে তা তদন্ত করতে বলেছিলাম। নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিটির প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দায়মুক্তির বিধানযুক্ত করে ২০২২ সালে প্রণীত আইনে যাকে খুশি তাকে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব। বর্তমানে যে আইন আছে তা কোনো আইনই নয়। একটি প্রজ্ঞাপনকে আইনে রূপান্তর করা হয়েছে। সেখানে নির্বাচন কমিশনকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন সংবিধান লঙ্ঘন করেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন পোস্ট অফিস নয় তারা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। আমি মনে করি, তারা সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। যে নির্বাচন গণতন্ত্রকে ব্যাহত করে সেই নির্বাচন সংবিধান সম্মত নয়। তিনি রাজনৈতিক ঐকমত্য ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে ইসি গঠনের প্রস্তাব করেন। নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের আইনকে বিতর্কিত আখ্যা দিয়ে সেই আইন বাতিলের দাবি তোলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান। তিনি বলেন, সৎ যোগ্য এবং সাহসী ব্যক্তিদের নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের সার্চ কমিটিতে নিতে হবে। তিনি বলেন, রাষ্ট্র সংস্কার একদিনে হয় না। তরুণরা যে দেশটা স্বপ্ন দেখেছে তা আসতে ৫ থেকে ৭ বছর লাগবে। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আসবে। বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক রুমিন ফারহানা বলেন, সরকারি দল সুষ্ঠু নির্বাচন না চাইলে ফেরেশতাকে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিয়েও সুষ্ঠু ভোট করা সম্ভব নয়। নির্বাচন কমিশনার কারা হবেন-সেই নাম রাজনৈতি দলগুলো থেকে নিতে হবে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, বিচার বিভাগকে কোনো অবস্থাতেই নির্বাচন কমিশন গঠনে যুক্ত করা উচিত হবে না। সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিক দল, সুশীলসমাজ ও ছাত্র প্রতিনিধির সমন্বয়ে সার্চ কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেন তিনি। জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, সবার আগে প্রয়োজন বিদ্যমান আইনটি (ইসি নিয়োগ আইন) বাতিল করা। তিনি বলেন, এমনভাবে কমিশন গঠন প্রক্রিয়া প্রণয়ন করতে হবে যাতে কোনো সরকার তা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী বলেন, অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা নয়, বাংলাদেশের বাস্তবতার আলোকে থেকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। গণতান্ত্রিক বন্দোবস্ত সরকার গঠনের পক্ষে মত দেন তিনি। গণঅধিকার পরিষদের (জিওপি) সভাপতি নুরুল হক নুর সাত শ্রেণিপেশার প্রতিনিধি নিয়ে সাত সদস্যের সার্চ কমিটি গঠনের পক্ষে মত দেন। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রফেসর আশরাফ আলী আকন্দ কমিশন সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করলে তাকে আইনের আওতায় আনার বিধান যুক্তের প্রস্তাব দেন। সংলাপে সুপ্রিমকোর্টের সাবেক রেজিস্ট্রার ইকতেদার আহমেদ নির্বাচন কমিশনারদের সংখ্যা পাঁচজন থেকে কমিয়ে তিনজন করার পক্ষে মত দেন। জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য আরিফুল ইসলাম আদিব বলেন, কমিশন গঠনে দল ছোট না বড় তা দিয়ে মতামত বিচার করা যাবে না। ডেমোক্রেসি ওয়াচের চেয়ারম্যান তালেয়া রহমান বলেন, সার্চ কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে ছাত্র-জনতার প্রতিনিধি রাখা প্রয়োজন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে সব সময় ভোট করা যেতে পারে। এতে সুষ্ঠু ভোট করা যাবে। নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা ফেমার প্রেসিডেন্ট মুনিরা খান বলেন, নির্বাচন কমিশন যদি ঠিকভাবে কাজ না করে তাহলে তাদের সরানোর ব্যবস্থা আইনে রাখতে হবে। সংলাপে মূল বক্তব্য পড়েন ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের মুখ্য পরিচালক ড. আব্দুল আলিম। তিনি পাঁচটি সুপারিশ তুলে ধরেন। সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদের সমালোচনা করে তিনি বলেন, এই ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেন। ওই বিধান সংশোধন করতে হবে। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রফেসর ড. রওনক জাহান। স্বাগত বক্তব্য রাখেন ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের চিফ অব পার্টি ডানা এল. ওল্ডস।