যোগ দেননি নতুন কর্মস্থলে লাশ পোড়ানো ঘটনার ‘মাস্টারমাইন্ড’ ওসি সায়েদ পালিয়েছেন

প্রকাশিতঃ সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৪ | ৬:০৪ অপরাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

সাভার উপজেলার আশুলিয়ায় গণহত্যার পর লাশ গুনে গুনে ভ্যানে তোলা ও আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় একে একে বের হয়ে আসছে আড়ালে থাকা কুশীলবদের নাম। এই প্রতিবেদকের নিজস্ব অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। দেশজুড়ে আলোচনার ঝড় তোলা এই ঘটনার ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে জানা গেছে আশুলিয়া থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এএফএম সায়েদের নাম। নিজের দায় এড়িয়ে ঘটনাটিকে ভিন্নখাতে প্রভাবিত করতে নানা কৌশল ও ছলনার আশ্রয় নিলেও শেষ পর্যন্ত ফেঁসেই যাচ্ছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ওসি এএফএম সায়েদ। গ্রেফতার আতঙ্কে ইতোমধ্যে গা ঢাকা দিয়েছেন পুলিশের এই কর্মকর্তা। খোদ পুলিশের একটি সূত্র জানায়, নিজেকে আড়াল করতে নানা কৌশল খাটিয়েও শেষ রক্ষা না হওয়ায় যে কোনো মুহূর্তে অবৈধ পথে দেশত্যাগের পরিকল্পনা করছেন সায়েদ। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে ইতোমধ্যেই ইমিগ্রেশনসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে তার বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে বলা হয়েছে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের মধ্য দিয়ে পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সেদিন বিকেলে লাশের স্তূপে আরো লাশ তোলা এবং পরে পোড়ানোর একাধিক ভিডিও প্রকাশ্যে এলে সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সূত্রমতে, বীভৎস ও নারকীয় ওই ঘটনার নির্দেশদাতা হিসেবে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। ডিউটি করেছেন সিভিল ড্রেসে। পড়নে ছিলো নীল রঙের পোলো শার্ট, কালো রঙের ট্রাউজার। এক হাতে ব্যান্ডেজ। ট্রাউজারের পকেটে ছিলো ওয়্যারলেস সেট। প্রচন্ড টেনশনে খেয়েছেন একের পর এক সিগারেট। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের দাপটে এএফএম সায়েদ ঢাকা জেলার একটানা চাকরি করেছেন একটানা ১০ বছর ১০ মাস ৬ দিন। এ সময়টাতে তিনি ঘুরেফিরে আশুলিয়া থানার সেকেন্ড অফিসার, গোয়েন্দা পুলিশ ঢাকা উত্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও সাভার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছেন। পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্রমতে, এএফএম সায়েদ ২০০৬ সালের ৫ মার্চ যশোর জেলা পুলিশ লাইনে এসআই পদে যোগ দেন। পদোন্নতি পেয়ে পরিদর্শক পদে ওসি হিসাবে যোগদান প্রথমে ঢাকা জেলা (উত্তর) গোয়েন্দা পুলিশে। তারপর ঘুরেফিরেই আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও সাভার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় অপরাধ জগতের মাফিয়া থেকে শুরু করে ভূমিদস্যু, ঝুট সন্ত্রাসীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে উপার্জন করেন কোটি কোটি টাকার অর্থ। সূত্রমতে, নিজের নামে না করলেও স্ত্রী স্বজনদের নামেই খুলনায় জাহাজ, জমি, ফ্ল্যাটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বেনামে সম্পদ গড়েছেন পুলিশের এই ধূর্ত কর্মকর্তা। এক দশকের বেশি সময় ঢাকায় থাকার কারণে পরে প্রাইস পোস্টিং হিসেবে ২০২১ সালের ২২ মার্চ তাকে বদলি করা হয় নারায়ণগঞ্জের আকর্ষণীয় রূপগঞ্জ থানায়। দ্বাদশ সংসদে ডামি নির্বাচনের প্রাক্কালে পুলিশের লোক দেখানো রদবদলে কেবলমাত্র জেলার এক থানা থেকে আরেক থানায় ওসিদের বদলি করা হলেও ব্যতিক্রম ছিলেন এএফএম সায়েদ। ২০২৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রূপগঞ্জ থেকে বদলি হয়ে যোগ দেন আশুলিয়া থানার ওসির দায়িত্বে। আশুলিয়া থানায় মাত্র ৮ মাস ২৩ দিন দায়িত্ব পালনের মধ্যে তার নেতৃত্বে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ঘিরে আশুলিয়া থানার ঘটে লাশ পোড়ানোর রোমহর্ষক বীভৎস ঘটনা। সেদিন গণহত্যা আড়াল করতে স্কুলছাত্র আস-সাবুর, আবদুল মান্নান, মিজানুর রহমান, তানজিল মাহমুদ সুজয়, সাজ্জাদ হোসেন সজল এবং বায়েজিদকে হত্যা করে আশুলিয়া থানার সামনেই পুলিশ ভ্যানে তাদের লাশ পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে আত্মগোপনে থাকা এএফএম সায়েদের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, এসব ঘটনায় তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তাহলে কেন নতুন কর্মস্থানে যোগদান না করে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন- এর কোনো সদুত্তর দেননি তিনি। যোগাযোগ করা হলে তদন্ত কমিটির প্রধান পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) সাজেদুর রহমান জানান, ঘটনাটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে সুক্ষভাবে তদন্ত করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে অর্ধশতাধিক পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। তদন্তে বেশ কিছু অগ্রগতি হয়েছে জানিয়ে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, তদন্তের প্রয়োজনে এএফএম সায়েদের সঙ্গেও কথা বলবে তদন্ত কমিটি। সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না এই প্রতিবেদককে বলেন, গুলি করার জন্য আইন আছে। প্রথমেই ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি লাগবে। ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৯৬-১০৬ ধারায় আত্মরক্ষার অধিকার সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। দণ্ডবিধির ৯৯ ধারায় বলা হয়েছে আঘাত যতটুকু প্রতিকারও ঠিক ততটুকু করতে পারবে। প্রতিঘাত আঘাতের বেশি হতে পারবে না। পিআরবিতে আছে, হাঁটুর নিচে গুলি করতে হবে। মাথায়, মুখে, বুকে গুলি করার কোনো এখতিয়ার নেই। যেভাবে গুলি করা হয়েছে সেটি আইনানুগ হয়নি। আর আশুলিয়ার ঘটনা তো গণহত্যা। সেই হত্যাযজ্ঞের আলামত ধ্বংস করার জন্য লাশ পুড়িয়ে দেওয়া বীভৎস ঘটনা জঘন্য অপরাধ। প্রতিটি ঘটনার তদন্ত হওয়া উচিত। এসব ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ছাড়াও আশুলিয়া থানায় পৃথক মামলায় তৎকালীন ও সি এএফএম সায়েদকে সন্দেহজনক আসামি করা হলেও এখনো তিনি রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। ঢাকার পুলিশ সুপার (এসপি) আহম্মদ মুঈদ জানান, মানবতাবিরোধী জঘন্য এমন অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। সায়েদ লাশ পেড়ানো মামলায় আমাদের সন্দহজনক আসামি। সে পলাতক থাকায় তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে জড়িত প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনা হবে। সূত্রমতে, ২০০৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি এসআই (নিরস্ত্র) পদে পুলিশে যোগ দেয়া এএফএম সায়েদ খুলনা মহানগরের ৪নং মিয়াপাড়া মহল্লার মো. ইসমাইলের ছেলে। তার পুলিশ পরিচিতি নং-বিপি-৮০০৬১৪৫৩৩৬।