ছাত্র রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত নতুন ষড়যন্ত্র

প্রকাশিতঃ সেপ্টেম্বর ২১, ২০২৪ | ৯:১১ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেক্স

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত ভুল এবং হঠকারী বলে মন্তব্য করেছেন ডাকসুর সাবেক তিন ভিপি। তারা বলেন, এটা নতুন ষড়যন্ত্রের অংশ। এই ভুল সিদ্ধান্তের কারণে পরিবেশ আরও খারাপ হবে। তরুণ তথা ভবিষৎ প্রজন্মের মধ্যে দেশপ্রেমের চেতনা কিংবা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়ার জায়গা হচ্ছে এই ক্যাম্পাস। সেখানে যারা ছাত্র রাজনীতি বন্ধের কথা বলছেন তাদের ভিন্ন উদ্দেশ্য থাকতে পারে। তিন ভিপি বিশ্বাস করেন, ছাত্র রাজনীতিকে অবারিত করাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ সুন্দর রাখার পথ। সেখানে নিয়মিত ছাত্র সংসদের নির্বাচন করা অপরিহার্য। বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেটের সভায় ঢাবি ক্যাম্পাসে ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সব ধরনের দলীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত কার্যকর থাকবে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি। এর পরিপ্রেক্ষিতে শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-ডাকসুর সাবেক তিন ভিপি-মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, মাহমুদুর রহমান মান্না ও নুরুল হক নুর কাছে এ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। বুধবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক (এফএইচ) হলে চোর সন্দেহে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। একই রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সাবেক নেতাকে পিটিয়ে হত্যা করে একদল শিক্ষার্থী। ঘটনা দুটি নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানা আলোচনা চলছে। প্রতিবাদ জানিয়েছে বিভিন্ন দল, সংগঠন ও নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। এই প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত ঢাবি সিন্ডিকেটের জরুরি সভায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সব ধরনের দলীয় রাজনীতি সাময়িক বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-ডাকসুর সাবেক ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ছাত্র রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্তটি বড় ভুল। এতে পরিবেশ আরও খারাপ করে তুলবে। ইতিহাস প্রমাণ করে ছাত্র রাজনীতির ওপরে যখনই নিষেধাজ্ঞা বা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়েছে, তখনই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ নষ্ট হয়েছে। সেটা আইয়ুব কিংবা ইয়াহিয়ার আমলেই হোক, স্বাধীন হওয়ার পর আওয়ামী লীগ বা বিএনপির বা জাতীয় পার্টির আমলেই হোক সব সময়ই এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। ছাত্র সমাজকে রাজনীতি সচেতন করার জন্য উৎসাহিত করা দরকার। বিশ্ববিদ্যালয় তথা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সমস্যা রাজনীতি বেশি হওয়ার জন্য নয়, বরং রাজনীতি কম হওয়ার জন্য সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, রাজনীতির নামে টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি, হেলমেট বাহিনী ইত্যাদি নানা অজুহাত দেখিয়ে সাধারণ ছাত্র সমাজের রাজনৈতিক তৎপরতা দমনের চেষ্টা করা হয়েছে। সেটার বিরুদ্ধেই ছাত্র সমাজ এবার বিদ্রোহ করল। এ বিদ্রোহ একটি রাজনৈতিক তৎপরতা। আর পশ্চিমা দুনিয়া বিরাজনীতিকরণের নানা ফর্মুলা দিয়ে থাকে। কিন্তু বিরাজনীতিকরণ একটা খুবই বিপজ্জনক ও ক্ষতিকর রাজনৈতিক মতবাদ। সুতরাং এ সিদ্ধান্ত থেকে বেরিয়ে আসবে হবে। তিনি বলেন, আমি সাধারণ ছাত্র সমাজের দেশপ্রেম, তাদের বিবেক-বিবেচনার প্রতি পরিপূর্ণভাবে আস্থাশীল। বিশ্বাস করি ছাত্র রাজনীতিকে অবারিত করাই হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ সুন্দর রাখার পথ। সেখানে ছাত্র সংসদের নির্বাচন নিয়মিত অনুষ্ঠান করা একান্তভাবে অপরিহার্য। ডাকসুর আরেক সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, এ সিদ্ধান্তটা কিসের পরিপ্রেক্ষিতে আসছে তা জানি না। ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার কোনো কারণ নেই। ছাত্র রাজনীতি সব সময়ই আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক ভ্যানগার্ড। পত্রিকায় যেটুকু পড়েছি তাতে বলা হচ্ছে লেজুড়বৃত্তি, চাঁদাবাজি, দুর্বৃত্তপরায়ণতার কারণে রাজনীতির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এর একটি ব্যাখ্যা দরকার। কারণ দুর্বৃত্ত যদি না থাকে তাহলে সে রাজনীতি করতে পারবে না কেন? সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়েছে, সেটা এ কারণেই যদি হয় সে ব্যাপারেও স্পষ্ট একটি কর্মপদ্ধতি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জানাতে হবে। এটা সবার সামনে উন্মুক্ত করলেই ভালো। তিনি বলেন, শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হবে কেন? যদি আমি ছাত্র রাজনীতি পরিশুদ্ধ করতে চাই সারা দেশের ছাত্র রাজনীতি পরিশুদ্ধ করতে হবে। একটা বড় যে ছাত্র গণঅভ্যুত্থান হয়ে গেল, ছাত্র রাজনীতি বন্ধ থাকলে করতে পারত? এটা কি রাজনীতি না? এখন তারা কি বুঝে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করতে চাইছে তা পরিষ্কার নয়। তারা যদি বলেন দুর্বৃত্তায়িত ছাত্র রাজনীতি, তাহলে তো দুর্বৃত্তায়িত জাতীয় রাজনীতিও বন্ধ করতে হবে। বুয়েটের মতো বন্ধ করে তা রাখতেও পারবে না। ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর মনে করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা একটা নতুন ষড়যন্ত্র। মাথা ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলা সমাধান না, তার চিকিৎসা করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বন্ধ করলে তো আমাদের জাতীয় রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। কারণ গত দেড় দশকে এই জাতীয় রাজনীতিতে গণতন্ত্র ছিল না, ফ্যাসিবাদ ছিল। যদি সেটা বন্ধ করতে হয়, এগুলো একেবারে উদ্ভট চিন্তা-ভাবনা। এখন কিছু শিক্ষার্থী বা তরুণ আবেগ থেকে দাবি জানাতে পারে। কিন্তু এটি তো বাস্তবসম্মত নয়। এটা সাময়িক সময়ের জন্য বিশেষ পরিস্থিতিতে হতে পারে, কিন্তু স্থায়ীভাবে হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এই ধরনের হঠকারী সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের নেওয়ার এখতিয়ারও নেই। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি না থাকলে ১৯৫২ সালে আমরা বাংলাকে মাতৃভাষা পেতাম না, উনসত্তরে গণঅভ্যুত্থান হতো না, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন দেশ পেতাম না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি না থাকলে নব্বয়ের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটাতে পারতাম না। এমনকি ২৪ সালে যারা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল প্রত্যেকের রাজনৈতিক পরিচয় আছে, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা আছে, তারা রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন থেকেই রাজনীতি ও নেতৃত্ব শিখেছে। সুতরাং ছাত্র রাজনীতি করেই তো তাদের মধ্যে এই দেশপ্রেম ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের চেতনা তৈরি হয়েছে। আজকে তরুণ প্রজন্ম কিংবা ভবিষৎ প্রজন্মের মধ্যে এই দেশপ্রেমের চেতনা কিংবা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তৈরি হওয়ার জায়গাটাতে ছাত্র রাজনীতি যারা বন্ধের কথা বলছেন, আমি মনে করি তা আরেকটা গভীর ষড়যন্ত্র। এর পেছনে কি কি বিষয় রয়েছে সেগুলো ভাবতে হবে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিত সংসদ নির্বাচন করার আহ্বান জানিয়ে ডাকসুর সাবেক এই ভিপি বলেন, তখন যে শিক্ষার্থীর মেধা আছে ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে গ্রহণযোগ্য তিনিই ছাত্রনেতা হবেন।