ছালাম- দোভাষে চট্টগ্রামের সর্বনাশ

প্রকাশিতঃ সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৪ | ৮:৩৪ পূর্বাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে (সিডিএ) গত ১৫ বছর তাদের ইশারাই ছিল আইন। মন্ত্রী-এমপি, বোর্ড সদস্য, শ্রমিক ও সাংবাদিক নেতা– চার পক্ষকে ম্যানেজের মাধ্যমে তারা ১৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে অন্তত ২৫টি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেন। কিন্তু ত্রুটিপূর্ণ এসব প্রকল্পের কোনোটিই নির্ধারিত সময়ে হয়নি। ফলে জলাবদ্ধতার মতো জনদুর্ভোগ রয়েই গেছে। মাঝে ফন্দি করে বরাদ্দ প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা বৃদ্ধি করে পকেটে পুরেছেন নগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ আবদুচ ছালাম ও সহসভাপতি এম জহিরুল আলম দোভাষ। জানা যায়, প্রকল্প অনুমোদন, পাস ও বরাদ্দের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের ঘুষ হিসেবে প্লট দেওয়া হতো। আমলারা সুযোগ পেতেন বিদেশে প্রমোদ ভ্রমণের। ছয় দফায় মোট ১০ বছর সরকারি সংস্থা সিডিএ চেয়ারম্যান ছিলেন ছালাম। আর দু’দফায় প্রায় ৫ বছর দায়িত্ব পালন করেন দোভাষ। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে দু’জন আত্মগোপনে চলে যান। সংশ্লিষ্টরা জানান, কোনো প্রকল্প পাসের আগে অনুমোদন দেয় সিডিএর বোর্ড সভা। সেটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর পর মন্ত্রী-এমপি সম্মতি দেন। পুরো প্রক্রিয়া নির্বিঘ্নে করতে ছালাম ও দোভাষ মন্ত্রী-এমপি ও বোর্ড সদস্যদের ‘নির্বিচারে’ প্লট দিয়েছেন। আবার প্রকল্পের বরাদ্দ আমলাদের হাতে। তাদের খুশি করতে বিদেশ ভ্রমণের ব্যবস্থা করা হতো। সিডিএর ছয় প্রকল্পের বিপরীতে ১৪ দেশে ভ্রমণ করেছেন অন্তত ৩৪ জন। দুই নেতার ‘সুনজর’ থেকে বাদ পড়েননি শ্রমিক ও সাংবাদিক নেতারা। প্লট পেয়ে শ্রমিক নেতারা কাজ চলাকালে চুপ থেকেছেন। সাংবাদিক নেতারা গেয়েছেন প্রকল্পের গুণগান। অনিয়ম ধামাচাপা দিতে গত ১৫ বছরে সিডিএ শতাধিক প্লট ঘুষ দিয়েছে। শুধু তাই নয়, সিডিএর গুরুত্বপূর্ণ পদে এখনও বসে আছেন ২২টি দুর্নীতি মামলার আসামিরা। সিডিএর ২৫ প্রকল্প অনুসন্ধানে এমন আরও পিলে চমকানো তথ্য পেয়েছে। সূত্র জানায়, প্রকল্প গ্রহণের আগে যথাযথভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই করেনি। নেয়নি বিশেষজ্ঞ মতামত কিংবা স্টেকহোল্ডারদের কথা। প্রায় সব প্রকল্পই ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় মাঝপথে পরিবর্তন হয়েছে নকশা। চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিংরোড প্রকল্পের নকশা সংশোধন হয়েছে চারবার। এজন্য ব্যয় বেড়েছে ২ হাজার ৪৬৮ কোটি টাকা। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নকশা পরিবর্তন হয়েছে তিনবার, ব্যয় বেড়েছে ১ হাজার ৪৯ কোটি টাকা। জলাবদ্ধতা নিরসনের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের নকশাও সংশোধন হয়েছে এবং ব্যয় বেড়েছে ২ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা। পরিবেশ রক্ষার দায়িত্বে থাকলেও মাত্র তিন কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে সিডিএ কেটেছে ১৬টি পাহাড়। জলাশয় ভরাট করে গড়েছে আবাসন প্রকল্প। কবরস্থানে বসিয়েছে দোকান। নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় অন্তত ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে জলাবদ্ধতার প্রকল্প এলাকায় শিশু, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, ব্যবসায়ীসহ অন্তত ১২ জন খাল ও নালাতে ভেসে মারা গেছেন। নগরের বহদ্দারহাটে সিডিএর নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের গার্ডার ধসে একসঙ্গে ১৬ প্রাণহানি হয়েছে। প্রতিটি মৃত্যুর ঘটনায় নামকাওয়াস্তে তদন্ত করে দায় সেরেছে কর্তৃপক্ষ। নানা মাধ্যমে চেষ্টা করেও আবদুচ ছালাম এবং জহিরুল আলম দোভাষের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে সরকার পতনের আগে অভিযোগের বিষয়ে তারা বলেছিলেন, মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া কোনো কাজ করা হয়নি। অনিয়ম-দুর্নীতির প্রশ্নই ওঠে না। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজনের) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী বলেন, ‘প্রকল্প এলাকায় বারবার মৃত্যু নিছক দুর্ঘটনা নয়, এগুলো হত্যাকাণ্ড। এর দায় সিডিএকে নিতে হবে। স্বজন হারানো পরিবারের উচিত, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা।’ পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সাধারণ সম্পাদক স্থপতি জেরিনা হোসেন বলেন, ‘সিডিএ প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে কখনও কারও মতামত নেয়নি। নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্টেকহোল্ডারদের উপেক্ষা করেছেন। এখানে চেয়ারম্যানই ছিলেন সর্বেসর্বা।’ বোর্ড সদস্য হলেই মেলে প্লট সব অনিয়ম বৈধ হতো সিডিএর বোর্ড সভায়। এ জন্য চেয়ারম্যানরা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে বোর্ড সভার সদস্য করতেন। এভাবে বিভিন্ন সময় সিডিএ থেকে প্লট বাগিয়েছেন বোর্ড সদস্য চট্টগ্রাম মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক কে বি এম শাহজাহান, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক জসিম উদ্দিন শাহ, স্থপতি সোহেল শাকুর, উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ নেতা জসিম উদ্দিন, চসিক কাউন্সিলর ও যুবলীগ নেতা হাসান মুরাদ বিপ্লব, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আ ম ম টিপু সুলতান চৌধুরী প্রমুখ। প্লট দিয়ে মন্ত্রী-এমপিকে খুশি রাখতেন ছালাম ২০১৩ সালের ৯ অক্টোবর সিডিএর ৪০৫তম বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, অনন্যা আবাসিক এলাকায় ৬০ জনকে সরাসরি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্লটের প্রতি কাঠা জমির দাম রাখা হয় মাত্র ৬ লাখ টাকা। অবৈধভাবে প্লট দিতে একই বছরের ২৬ ডিসেম্বর আবাসিক এলাকাটির নকশা পরিবর্তন করা হয়। এভাবে প্লট পেয়েছেন আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী দীপংকর তালুকদার, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, নুরুল ইসলাম বিএসসি, সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, সাবেক এমপি এ বি এম আবুল কাশেম মাস্টার, আবদুল লতিফ, শামসুল হক, এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী, চেমন আরা তৈয়ব, জাসদের কার্যকরী সভাপতি প্রয়াত মঈনউদ্দিন খান বাদল, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ প্রমুখ। শ্রমিক নেতাকে বাগে নিতে দেন প্লট-দোকান শ্রমিক লীগের নেতাকর্মীকে গোপনে প্লট বরাদ্দ দিয়েছেন ছালাম। ২০১৪ সালের ৩০ জুন ডেকে এনে প্লট বরাদ্দ দেন তিনি। প্লট পাওয়া পাঁচ শ্রমিক লীগ নেতা হলেন- জয়নাল আবেদীন, আবদুর রশিদ, স্বপন ভৌমিক, মঈনুল ইসলাম খান টনি ও মো. আলমগীর। সিডিএ এমপ্লয়িজ কো-অপারেটিভ মাল্টিপারপাস সোসাইটি লিমিটেডের নামে চারটি দোকানও বরাদ্দ দেওয়া হয়। কর্ণফুলী মার্কেটের দুটি দোকান পান সোসাইটির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খান ও সদস্য মঈনুল ইসলাম খান টনি। আর সিডিএ ক্যান্টিন-সংলগ্ন দুটি দোকান পান ভারপ্রাপ্ত উপসহকারী প্রকৌশলী দীপক বড়ুয়া ও সাইফুল ইসলাম। ২৭ প্লট বাতিলেও থামেনি জালিয়াতি ২০০৯ সালের শুরুর দিকে অনন্যা আবাসিকে প্লট বরাদ্দ দেয় সিডিএ। এ সময় মন্ত্রী-এমপির স্বজনসহ প্রভাবশালীদের প্লট দিতে অভিনব জালিয়াতি করা হয়। পরে অনিয়মের অভিযোগ উঠলে তদন্তে জালিয়াতির প্রমাণ পেয়ে ২৭টি প্লটের বরাদ্দ বাতিলের সুপারিশ করে দুদক। পরে ২০১৪ সালের মে মাসে সিডিএর বোর্ড সভায় বরাদ্দ বাতিল করা হয়। কিন্তু তার পরও থামেনি জালিয়াতি। পরবর্তী সময়েও অনিয়ম করেই প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আমলাসহ ৩৪ জনের ১৪ দেশ ভ্রমণ আবাসন সংকট নিরসনে ২০১৭ সালে ‘অনন্যা আবাসিক এলাকার উন্নয়ন (দ্বিতীয় পর্যায়)’ নামে একটি প্রকল্প নেয় সিডিএ। এর অধীনে যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা ভ্রমণ করেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিবসহ ৫ কর্মকর্তা। এতে সিডিএর ব্যয় হয় ১ কোটি ৮ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। ভ্রমণ শেষে সিডিএ বলেছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে বাতিল করা হয়েছে। এভাবে সিডিএর ছয় প্রকল্পের অধীনে ৩৪ জনের বিদেশ সফরের তথ্য মিলেছে অনুসন্ধানে, যাদের ২৩ জনই প্রকল্পের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত নন। বিদেশ সফরকারীর ওই তালিকায় আছেন সিডিএর বোর্ড সদস্য, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তি। তারা যুক্তরাষ্ট্র-কানাডাসহ ১৪টি দেশ সফর করেন। এসব সফরের খরচ বহন করে সিডিএ, পরামর্শক ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। উপেক্ষিত বিশেষজ্ঞ পরামর্শ ২০০৮ সালে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে প্রথম ফ্লাইওভার নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সিডিএ। এটি হলে ভবিষ্যতে নগরে বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) ও মাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) বাস্তবায়নের পথ রুদ্ধ হবে বলে দফায় দফায় সংবাদ সম্মেলনে জানান নগর পরিকল্পনাবিদরা। তারা ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাসহ নানা পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুই আমলে নেয়নি সিডিএ। তারা চারটি ফ্লাইওভার ও একটি এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করে। ২০১৯ সালে চট্টগ্রাম নগরে মেট্রোরেলের প্রাক-যোগ্যতা সমীক্ষা চালানো হলে আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভার ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত করে বাসস্থান ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড কনসালট্যান্টস লিমিটেড। পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহসভাপতি প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বলেন, ‘আশঙ্কার কথা ২০০৮ সালেই বলেছিলাম, তারা শোনেননি। এখন ভিন্ন পথে এমআরটি হলেও ব্যয় কয়েক গুণ বাড়বে।’ আসামিরা বহাল তবিয়তে কালুরঘাট রোড উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে নগরের চান্দগাঁও থানায় ২২টি মামলা করে দুদক। এসব মামলায় সিডিএর ২৫ প্রকৌশলী, ২২ ঠিকাদারসহ ৪৭ জনকে আসামি করা হয়। তদন্তে ছয়জনের সংশ্লিষ্টতা না পাওয়ায় তাদের বাদ দিয়ে ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় দুদক। কিন্তু আসামিদের অনেকেই এখন সিডিএর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন।