বিদ্যুতের স্মার্ট প্রিপেইড মিটারের অবৈধ বাণিজ্য পাঁচশ কোটি টাকা পাচারে জড়িত সিন্ডিকেট

প্রকাশিতঃ সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৪ | ৯:৪৩ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেক্স

বিদ্যুতের স্মার্ট প্রিপেইড মিটার তৈরির নামে ‘মেইড ইন বাংলাদেশে’র আড়ালে ৫শ কোটি টাকার বেশি অর্থ পাচারের অভিযোগ উঠেছে। এ প্রক্রিয়ায় বিদেশ থেকে নিম্নমানের মিটার কিনে সেগুলোর গায়ে মেইড ইন বাংলাদেশ লেখা হয়। এরপর দেশীয় পণ্য বলে বিভিন্ন কোম্পানির কাছে বিক্রি করা হয়। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্মার্ট ইলেকট্রিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড (বেসিকো), বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ওজোপাডিকো), চীনের কোম্পানি হেক্সিং ইলেকট্রিক্যাল লিমিটেড ও সেনজেন স্টার ইকুইপমেন্ট নামের এই চারটি কোম্পানি মিলে গড়ে ওঠা একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট এই লুটপাট আর পাচারের সঙ্গে জড়িত ছিল। এই জালিয়াতচক্রের সামনে ছিলেন সদ্য বিদায়ি শেখ হাসিনা সরকারের সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও আবাসন ব্যবসায়ী আলমগীর শামসুল আলামিন কাজল ও নসরুল হামিদ বিপুর স্ত্রীর বড় ভাই মাহবুব রহমান তরুণ। এদের মধ্যে বেসিকোর সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চার করা চাইনিজ প্রতিষ্ঠান হেক্সিং ইলেকট্রিক্যাল লিমিটেডের স্থানীয় প্রতিনিধি হলেন আলমগীর শামসুল আলামিন কাজল এবং আরপিসিএলের সঙ্গে জয়েন্টভেঞ্চার করা চাইনিজ প্রতিষ্ঠান সেনজেন স্টার ইকুইপমেন্টের স্থানীয় প্রতিনিধি হলেন মাহবুব রহমান (তরুণ)। সম্প্রতি এই চক্রের বিরুদ্ধে বাজার মূল্যের চেয়ে দ্বিগুণ বেশি দামে ডিপিএম (ডাইরেক্ট প্রকিউরমেন্ট মেথড) পদ্ধতিতে প্রিপেইড মিটার কেনাকাটার অভিযোগ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, ডিপিএম বাণিজ্য, এলসির মাধ্যমে অর্থ পাচার, দুর্নীতি, জাল-জালিয়াতিসহ বিভিন্ন খাতে এই চক্রটি দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সরকারের তদন্ত কমিটি ও নিজস্ব অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে উল্লিখিত সব চাঞ্চল্যকর তথ্য। অনুসন্ধানে জানা গেছে, খরচ কমানো এবং আমদানির পরিবর্তে দেশে বিদ্যুতের স্মার্ট প্রিপেইড মিটার সংযোজনের উদ্যোগের অংশ হিসাবে কয়েক বছর আগে সরকার আলাদা দুটি কোম্পানি গঠন করে। চীনের দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানগুলো গঠন করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে-বাংলাদেশ স্মার্ট ইলেকট্রিক্যাল কোম্পানি (বেসিকো), যার অংশীদার ওয়েস্টজন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড ও চীনের হেক্সিং ইলেকট্রিক্যাল লিমিটেড। আরেকটি হচ্ছে সরকারি প্রতিষ্ঠান রুরাল পাওয়ার কোম্পানি (আরপিসিএল) এবং চীনের স্যানজেন স্টার ইকুইপমেন্ট এর সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ পাওয়ার ইকুইপমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি (বিপিইএমসি)। পিপিআর ২০০৮ অনুযায়ী সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ার সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা থাকলেও পিপিআরএর বিধিমালা তোয়াক্কা না করেই বিপিইএমসি থেকে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) ২ লাখ ৫০ হাজার স্মার্ট মিটার ক্রয় করে। মূলত আরইবি‘র সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগসাজশে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর বন্ধু আলমগীর শামসুল আলামিন কাজল এবং স্ত্রীর ভাই মাহবুব রহমান (তরুণ) পুরো বাণিজ্য শেষ করেন। দুই কোম্পানির নিজস্ব নিরীক্ষায়ও (অডিট) এ দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে। তাদের ব্যালেন্সশিট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কেনাকাটা ও কোম্পানি পরিচালনায় বিশাল অনিয়ম ধরা পড়ে। দেখা গেছে দেশে সংযোজিত স্মার্ট প্রিপেইড মিটারের দাম আমদানি করা একই ধরনের মিটারের চেয়ে বেশি দেখানো হয়েছে। কাঁচামাল ক্রয়ে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রে না গিয়ে সরাসরি তাদের অংশীদার চীনা কোম্পানি থেকে উচ্চমূল্যে আমদানি করা হয়েছে। এভাবে কেনাকাটার কারণে শত শত কোটি টাকা লোপাট ও পাচার হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। সাধারণত বিদেশ থেকে পণ্য ক্রয় করা হলে, সরবরাহকারী বিনামূল্যে বিক্রয়-উত্তর সেবা প্রদান করার শর্ত থাকে, কিন্তু বিদেশে টাকা পাচারের উদ্দেশ্যে প্রশিক্ষণ কারিগরি সহায়তা কিংবা বিক্রয়-উত্তর সেবার নামে ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে বিদেশে টাকা পাচার করা হয়েছে। পাশাপাশি ভুয়া বিল-ভাউচার, স্বাক্ষর জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। কর্মী নিয়োগেও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ প্রসঙ্গে ওজোপাডিকোর বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. শামছুল আলম বলেন, ‘এসব ঘটনা আমার আমলে হয়নি। এ নিয়ে মামলা হয়েছে। দুদক তদন্ত করছে। তবে তিনি বলেন, বেসিকোকে নিয়ে আগামীতে আমাদের ভালো কিছু করার টার্গেট আছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু অর্ডারও আসছে। ফান্ডও গঠন করা হয়েছে। তিনি বলেন, বেসিকোর বিদেশি পার্টনার চীনের হেক্সিং ইলেকট্রিক্যাল লিমিটেডকে নিয়েও আমরা বৈঠক করেছি। তাদের বলে দিয়েছে বাংলাদেশে যত কাজ করবে সব টেন্ডারে বেসিকোকে সঙ্গে রাখতে হবে। একা কোনো টেন্ডারে অংশগ্রহণ করা যাবে না। এটি করা না গেলে বেসিকো লোকসানে পড়বে। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ও বিষয়টি জানে। ওজোপাডিকোর সাবেক নির্বাহী পরিচালক (অর্থ) রতন কুমার দেবনাথ বলেন, বেসিকোর এই অনিয়ম-দুর্নীতি দেশের ইতিহাসে অন্যতম বড় একটি কেলেঙ্কারি। এই প্রকল্পে অর্থ পাচার, দুর্নীতি, জাল-জালিয়াতিসহ এমন কিছু নেই যা হয়নি। ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, পাঁচটি বিতরণ সংস্থায় ডিপিএম পদ্ধতিতে পাঁচ লাখ ৮৫ হাজার স্মার্ট প্রিপেইড মিটার কেনা হয়েছে। এর মধ্যে থ্রিফেজ মিটার ছিল ৬৮ হাজার। বাকি পাঁচ লাখ ১৭ হাজার মিটার সিঙ্গেল ফেজ। মোট দাম পড়ে ৬৬৮ কোটি টাকা। গড়ে প্রতিটি মিটারের দাম সাড়ে ১১ হাজার টাকা। কিন্তু উন্মুক্ত দর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কেনা হলে এর চেয়ে অর্ধেক দামে কেনা যেত বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। অর্থাৎ এখানে সরকারের প্রায় ৩৩৪ কোটি টাকা অপচয় বা লোপাট হয়েছে। বেসিকোর প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিক উদ্দিন অবসরের পর তার স্থলাভিষিক্ত হন রতন কুমার দেবনাথ। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়ে জানান, কোম্পানি অতীতে বিভিন্ন পণ্যের বিপরীতে বেশি বিল দেখিয়ে এবং স্বাক্ষর জালিয়াতি করে এলসির বিল পরিশোধের মাধ্যমে অর্থ পাচার করেছে। তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ওই বিলগুলো পরিশোধ না করার অনুরোধ করেন। দেবনাথের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ৩০ কোটি ২৬ লাখ টাকা এলসির মাধ্যমে চীনা কোম্পানি হেক্সিংকে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে, যা অর্থ পাচারের শামিল। বিএসইসিওর ৫১ শতাংশ মালিক সরকারি প্রতিষ্ঠান ওজোপাডিকো। তাই বিদেশে অর্থ পাচার হলে সরকারের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে। অডিট প্রতিবেদনে ২০১৯ ও ২০২০ সালে ৯৮ কোটি ৮ লাখ টাকার এলসি খোলার প্রমাণ রয়েছে। এর মধ্যে ৭৩ কোটি ৮৬ লাখ টাকার প্রিপেইড মিটার ও যন্ত্রাংশ কেনা হয়। বাজারদর ও চুক্তির তুলনায় বেশি দাম দেখানো হয়েছে, যা অর্থ পাচারের আশঙ্কা তৈরি করেছে। সফটওয়্যার কেনা ও প্রশিক্ষণের জন্য ৩৬ কোটি টাকার এলসি খোলার পরও কোনো প্রশিক্ষণের প্রমাণ পাওয়া যায়নি, যা এই অর্থের পাচারের উদ্দেশ্য হতে পারে। উদাহরণ হিসাবে প্রতিবেদনে বলা হয়, এমডিএম/এইচইএম সিস্টেম কেনার জন্য চুক্তি অনুসারে হেক্সিংকে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা দেওয়ার কথা। কিন্তু ২০২০ সালের ২৬ জানুয়ারি একটি ব্যাংকে ১০ কোটি ৩৭ লাখ টাকার এলসি খোলা হয়। অর্থাৎ ৯ কোটি ১৭ লাখ টাকা অতিরিক্ত বিল দেওয়ার মাধ্যমে অর্থ পাচারের ব্যবস্থা করা হয়। প্রতিবেদনে এসব অনিয়মের জন্য সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিক উদ্দিন, পরিচালক অর্থ আব্দুল মোতালেব এবং উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ইয়ে ওয়েনজুকে অভিযুক্ত করা হলেও তৎকালীন প্রতিমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তারা বেকসুর খালাস পান। শর্তভঙ্গ করে মিটার আমদানি : ২০১৯ সালের ৩০ মে বিদ্যুৎ বিভাগের তৎকালীন সিনিয়র সচিব ড. আহমেদ কায়কাউস স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে বেসিকোর মিটার সরবরাহের ক্ষেত্রে শর্ত দেওয়া হয়েছিল যে, মিটারগুলো অবশ্যই বাংলাদেশে সংযোজন করে সরবরাহ করতে হবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালে ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) বেসিকোকে ৬৯,১৬০টি মিটার সরবরাহের অর্ডার দেয়। তবে বেসিকো চীনের তৈরি রেডিমেড মিটার আমদানি করে, যা ছিল সরাসরি চুক্তি লঙ্ঘন। আমদানি করা মিটারগুলোতে ‘ম্যানুফ্যাকচার্ড ইন বাংলাদেশ’ উল্লেখ থাকলেও তা বাংলাদেশে তৈরি হয়নি। এছাড়া উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে (ওটিএম) মিটার কেনা হলে ওজোপাডিকোর প্রায় ১৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা সাশ্রয় হতো। কারণ তৈরি মিটার আমদানির জন্য বেসিকো ১০ শতাংশ শুল্কের পরিবর্তে ১৫ শতাংশ শুল্ক প্রদান করে, যার ফলে সরকারের বাড়তি খরচ হয়। সি ফ্রেইট অ্যান্ড ট্রান্সপোর্টেশন বাবদ ২ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে, যদিও শিপিং মেমো কিংবা শিপিং কোম্পানির কোনো নথি পাওয়া যায়নি। প্রকৃতপক্ষে ১ লাখ ৯০ হাজার পিস মিটার আমদানির জন্য সি ফ্রেইট বাবদ ৩৭ লাখ টাকার বেশি খরচ হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ২.৫ কোটি টাকা বিল করা হয়। স্মার্ট মিটারকে সেবা ক্রয় খাত দেখিয়ে ৩৩ কোটি টাকা পাচার : ওজোপাডিকোর সঙ্গে বেসিকোর মিটার ক্রয় চুক্তিতে কোনো ধরনের সেবা খাতের কথা উল্লেখ ছিল না। কিন্তু এই প্রকল্পে শুধু একটি ব্যাংকের ৬টি এলসির মাধ্যমে ৩১ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রয়েছে এমডিএম ও হেস সিস্টেম খাতে ১০ কোটি ৩৬ লাখ, ইনস্টলেশন টেস্টিং ফর এমডিএ ও হেস সিস্টেম খাতে ৩ কোটি ১৪ লাখ, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট ও টেকনিক্যাল সাপোর্ট সার্ভিস খাতে ৫ কোটি ৫২ লাখ, বিদেশে ট্রেনিং খাতে ২ কোটি ৯৭ লাখ, ৩ বছরের ওয়ারেন্টি খাতে ৭ কোটি ২১ লাখ এবং ৩ বছরের অপারেশন সাপোর্ট খাতে ২ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। ২০২০ সালের ২৫ অক্টোবর বেসিকো একটি এলসি খোলে, যেখানে এমডিএম এবং হেস সিস্টেম সফটওয়্যারের জন্য ১০.৩৭ কোটি টাকার এলসি ছিল, অথচ এর প্রকৃত চুক্তি ছিল ১.২০ কোটি টাকা। ফলে অতিরিক্ত ৯.১৭ কোটি টাকা পাচার করা হয়। ওজোপাডিকোর নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৩ কোটি ১৫ লাখ টাকার ইনস্টলেশন ও টেস্টিং ব্যয় দেখানো হলেও এ খাতে কোনো বরাদ্দ ছিল না। এছাড়া বিদেশে প্রশিক্ষণ খাতে ২.৯৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেখানো হলেও প্রকৃত প্রশিক্ষণ খরচ ছিল ৪২ লাখ টাকা। ওজোপাডিকোর কোনো কর্মীকে বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়নি। এছাড়া তিন বছরের ওয়ারেন্টির জন্য ৭.২২ কোটি টাকার এলসি খোলা হয়, যদিও ওয়ারেন্টির বিষয়ে কোনো চুক্তি ছিল না। বেসিকো প্রতিটি সিঙ্গেল ফেজ মিটার ডিপিডিসিকে ৪ হাজার ৫০০ টাকায় এবং ওজোপাডিকোকে ৫ হাজার ৮৮৯ টাকায় বিক্রি করেছে। যার ফলে প্রতিটি মিটারে ১,৩৮৯ টাকা বেশি নেওয়া হয়। এর ফলে সরকারের ২৪ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। ওজোপাডিকোর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সঠিক বাজেট প্রণয়ন করলে বেসিকোর প্রকৃত লাভ ২৩.৬ কোটি টাকা হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু দেখানো হয় মাত্র ৭.৩৮ কোটি টাকা, যা মূলত অর্থ পাচারের উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। এ ঘটনায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে, যা মানি লন্ডারিং আইনের আওতায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। প্রশিক্ষণ না নিয়েও বিল ১৮ কোটি টাকা : নিরীক্ষা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বেসিকো বিদ্যুতের স্মার্ট প্রিপেইড মিটারের মাধ্যমে গ্রাহকসেবার মানোন্নয়নের জন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণ করিয়েছে। এতে খরচ দেখানো হয় ১৮ কোটি ১৪ লাখ টাকা। পাওয়ার ডিভিশন ও দুদকের একাধিক তদন্তেও প্রশিক্ষণের নামে ভুয়া কাগজ দেখিয়ে হেক্সিং কোম্পানির মাধ্যমে এলসিতে কোটি টাকা পাচারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। যদিও প্রশিক্ষণের কোনো খরচ ছিল না। হেক্সিং ইলেকট্রিক্যাল কোম্পানি এবং সেনজেনস্টার এই দুটি কোম্পানি সরকারি ইলেকট্রিক কোম্পানি থেকে সরাসরি ডিপিএম পদ্ধতিতে কাজ নেওয়ার জন্য তাদের জেভি কোম্পানি বেসিকো ও বিপিইএমসি ব্যবহার করত। নিয়ম অনুযায়ী মিটার পার্টস সংগ্রহ করার কথা উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে। কিন্তু সেটা না করে তাদের চীনস্থ ফ্যাক্টরি থেকে মিটার পার্টস আমদানি করত। যার বেশির ভাগ ছিল নিুমানের। এরপর এসব পণ্য দেশে এনে নামমাত্র এসেম্বলি দেখিয়ে সরকারি ইলেকট্রিক কোম্পানিগুলোতে সরবরাহ করে। এভাবে একদিকে কোম্পানিগুলোকে নিুমানের পণ্য সরবরাহ করা হতো, অন্যদিকে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাচার করা হতো। এছাড়া বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সংস্থা যখন উন্মুক্ত টেন্ডারিং পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বান করে, তখন এই দুটি চীনা কোম্পানি সরাসরি দরপত্রে অংশগ্রহণ করে। এ সময় তাদের বাংলাদেশস্থ জেভি কোম্পানিকে উন্মুক্ত দরপত্রে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখে। কারণ জেভি কোম্পানির মাধ্যমে করলে লভ্যাংশ দিতে হয়। এভাবে কাজ নিয়ে পুরো লভ্যাংশই তারা বিদেশে নিয়ে যেত। বিশেষজ্ঞরা বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়কে অবিলম্বে এই দুই কোম্পানির সব ধরনের কার্যক্রম মনিটরিং করার দাবি জানান। যৌথ অংশীদারত্বে কোনো বিদেশি কোম্পানি যদি সরাসরি দরপত্রে অংশগ্রহণ করে তাদের অযোগ্য ঘোষণা করতে আইন প্রণয়নেরও দাবি জানান। এছাড়া যে কোনো উন্মুক্ত দরপত্রে যৌথ অংশীদারত্ব আছে এমন কোম্পানিকে অবশ্য বাংলাদেশে অবস্থিত তাদের জেভি কোম্পানির মাধ্যমে অংশগ্রহণ করতে হবে। যাতে সরকারি কোম্পানি বা সরকার লাভবান হতে পারে। এতে দেশে কর্মসংস্থান তৈরি হবে। একই সঙ্গে মিটারের পার্টস তৃতীয় পক্ষের উৎস থেকে আমদানি করতে হবে। টেন্ডার ছাড়া সরাসরি ক্রয়ের মাধ্যমে মিটারের পার্টস সংগ্রহ করা যাবে না। তা না হলে টাকা পাচার থামানো যাবে না। দুর্নীতি দমন কমিশনকেও এ বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। বর্তমানে দুদক এসব বিষয়ে অবগত থাকা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ‘একটা চক্র গড়ে উঠেছিল।’ বেসরকারি খাতসংশ্লিষ্ট, সরকারি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের আমলা, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের লোকজনকে নিয়ে এই চক্রটি গড়ে উঠেছিল। এভাবে বিগত সরকারের আমলে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রতিষ্ঠানকে বামন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। ফলে জাতীয় চাহিদাসম্পন্ন নীতি কখনো প্রণয়ন করা হয়নি। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে কোনো ব্যক্তিস্বার্থে বা কোনো গোষ্ঠী স্বার্থে। আমরা দেখতে চাই এই চক্র ভেঙে গেছে। নীতি ও আইন নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার তাদের অবস্থান পরিষ্কার করবে। এ বিষয়ে আবাসন ব্যবসায়ী ও এফবিসিসিআই নেতা আলমগীর শামসুল আলামিন কাজলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার ফোনটি বন্ধ পাওয়া গেছে।