বিশ্বব্যাংকে ধরনা দিতেই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ

প্রকাশিতঃ সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৪ | ৯:৫৪ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেক্স

রাজধানীর ৭টি এলাকার অবকাঠামো উন্নয়নে ৫ বছর আগে ‘ঢাকা সিটি নেইবারহুড আপগ্রেডেশন প্রজেক্ট (ডিসিএনইউপি)’ হাতে নেয় স্থানীর সরকার বিভাগ। কিন্তু শর্ত অনুযায়ী যে কোনো কাজ করার আগে বিশ্বব্যাংকের এনওসি (নো অবজেকশন সার্টিফিকেট) নেওয়ার বিধান ছিল। সেটি অনুসরণে সংস্থাটির কাছে বারবার ধরনা দিতেই চলে গেছে অনেকটা সময়। সেই সঙ্গে আছে নানা জটিলতাও। ফলে মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৮ শতাংশ। এ অবস্থায় বর্তমানে ব্যয় কমিয়ে এবং মেয়াদ বাড়িয়ে প্রথম সংশোধনী প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। ৩ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হবে প্রস্তাবের ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের। প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘ঢাকা সিটি নেইবারহুড আপগ্রেডেশন প্রজেক্ট (ডিসিএনইউপি)’ নামের প্রকল্পটি বিশ্বব্যাংকের একটি ফ্রেমওয়ার্ক প্রকল্প। এটি তৈরির সময় বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ অনুযায়ী ধারণাগত পরিকল্পনা ও প্রাক্কলন তৈরি করা হয়েছিল। সংস্থাটির গাইডলাইন অনুযায়ী প্রকল্পের প্রত্যেকটি সাব প্রজেক্ট গ্রহণ ও অনুমোদনের ক্ষেত্রে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, সাব প্রজেক্ট স্ক্রিনিং, স্ক্রিনিং রিপোর্ট, সামাজিক, পরিবেশগত, ট্রাফিক, রিসেটেলমেন্ট বা রি লোকেশন প্রকল্প চলাকালীন করা হয়েছে। এসব কাজ করার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের প্রজেক্ট এপ্রাইজাল ডকুমেন্টে (পিএডি) উল্লেখ আছে। এছাড়া প্রতিটি পর্যায়ে বিশ্বব্যাংকের ছাড়পত্র বা এনওসি পাওয়ার পরই শুধু ভৌত কার্যক্রম শুরুর নির্দেশনা ছিল। এসব কারণে প্রতিটি ধাপে সংস্থাটির অনুমোদনের পর ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে যথেষ্ট সময় লেগে যায়। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সাবেক সিনিয়র সচিব কাজী শফিকুল আজম শনিবার বলেন, নিশ্চয়ই বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে যখন চুক্তি হয়, তখনই সব বিষয়ে আলোচনা করে ঋণটি নেওয়া হয়েছিল। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে যদি অনুমোদন বা এনওসি প্রক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংক অতিমাত্রায় সময়ক্ষেপণ করে থাকে তাহলে সংস্থাটি দায় এড়াতে পারে না। আবার কোনো প্রকল্পের গতিহীনতার পেছনে একক কোনো কারণও থাকে না। যেমন প্রকল্পটি যারা বাস্তবায়ন করছেন তাদেরও দক্ষতার অভাব থাকতে পারে। এছাড়া কার্যকর মনিটরিংয়ের অভাব ছিল বলে মনে হচ্ছে। আবার দেখা যাচ্ছে, প্রকল্পের শুরু থেকেই সমস্যা ছিল-এক্ষেত্রে প্রকল্পের এমন দশায় কোনো পক্ষই দায় এড়াতে পারে না। জানা গেছে, প্রকল্পটি ২০১৯ সালের ৫ মার্চ একনেকে অনুমোদন পায়। কিন্তু প্রকল্পের আওতায় ডিজাইন, সুপারভিশন ও মনিটরিং পরামর্শক নিয়োগ করা হয় প্রায় ২০ মাস পর। এরপরই সাব প্রজেক্টগুলো স্ক্রিনিং করে সাব প্রজেক্ট পাইপলাইন তৈরি করা হয়। পাশাপাশি প্যাকেজ ও ব্যয় পুনর্বিন্যাস করে ক্রয় পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে আরও যেসব জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিল সেগুলো হচ্ছে, করোনা মহামারির অভিঘাত, নির্মাণ সাইটে পুরাতন স্থাপনা ভাঙা এবং অপসারণে অনেক সময় চলে যায়। এসব কারণে প্রকল্পের কাজে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি সম্ভব হয়নি। বাস্তবতা বিবেচনা করে এর আগে প্রকল্পের মেয়াদ ২ বছর বাড়ানোর জন্য অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) মাধ্যমে বিশ্বব্যাংককে অনুরোধ জানানো হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে সংস্থাটি ২ বছরের পরিবর্তে এক বছর অর্থাৎ ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়াতে সম্মত হয়েছে। সেই সঙ্গে বৈদেশিক ঋণ অংশে ১০ কোটি ডলার থেকে আড়াই কোটি ডলার কমিয়ে দিয়েছে। এজন্য ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) সংশোধনের বিকল্প ছিল না। ফলে কাজের কিছু প্যাকেজও বাতিল করা হয়েছে। সূত্র জানায়, প্রকল্পটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কামরাঙ্গীরচর, লালবাগ, নয়াবাজার, সূত্রাপুর, গুলিস্তান, খিলগাঁও, মুগদা এবং বাসাবো এলাকায় বাস্তবায়নের জন্য গ্রহণ করা হয়। এটি বাস্তবায়নের ফলে প্রায় ১৪ লাখ মানুষ সেবা পাওয়ার কথা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮৮০ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ৪৫ কোটি ৯৭ লাখ এবং বিশ্বব্যাংকের ঋণ থেকে ৮৩৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ব্যয় করার লক্ষ্য ধরা হয়। এখন প্রকল্পের প্রথম সংশোধনী প্রস্তাবে ৪৯ কোটি ৬৭ লাখ টাকা কমিয়ে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৩০ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ৩৭ কোটি ৬৬ লাখ এবং বিশ্বব্যাংকের ঋণ ৭৯৩ কোটি ১২ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে অনুমোদিত ব্যয়ের তুলনায় মোট প্রকল্প খরচ কমছে ৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এদিকে যখন প্রকল্পটি একনেকে (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি) অনুমোদন দেওয়া হয় তখন মেয়াদ ছিল ২০১৯ সালের মার্চ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। এখন এক বছর বাড়িয়ে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। শুরু থেকে জুন পর্যন্ত প্রকল্পের আওতায় খরচ হয়েছে ১৩৫ কোটি ২৩ লাখ টাকা, আর্থিক অগ্রগতি ১৬ দশমিক ২৮ শতাংশ। এছাড়া ভৌত অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ১৮ শতাংশ। পরিকল্পনা কমিশনের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, ৩ অক্টোবর অনুষ্ঠেয় পিইসি সভায় বেশ কিছু বিষয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে যাচ্ছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। এর মধ্যে অন্যতম হলো-মূলধন খাতে বিভিন্ন অঙ্গের কাজের পরিধি কমানো ও রাজস্ব অংশে ব্যয় (ব্যক্তি ও ফার্ম) বাড়ানোর কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা হবে। পাশাপাশি ভৌত কাজের পরিমাণ কেন কমেছে কিন্তু বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শক, অডিট ফার্ম এবং লিভেবল মেবারহুড ফান্ড এর সংস্থান বাড়ানোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হবে। এসব ক্ষেত্রে ব্যয় বাদ দেওয়ার সুপারিশ দিতে পারে পরিকল্পনা কমিশন। গত ৫ বছরে প্রকল্পের অগ্রগতি যেখানে এত কম সেখানে আগামী এক বছরে পুরো কাজ শেষ করা যাবে কিনা সেটি প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এ বিষয়টি পরীক্ষা করতে বলা হবে। সেমিনার, ওয়ার্কশপ এবং প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যয় প্রস্তাব বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলেও মনে করছে পরিকল্পনা কমিশন। কোথাও প্রয়োজনের তুলনায় বেশি আবার কোথাও কম ধরা হয়েছে-এসব বিষয়ে নতুন করে প্রশ্ন উত্থাপনসহ এর পুনরাবৃত্তি রোধের উদ্যোগ নেওয়ার চিন্তা চলছে।