নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা নিয়ে বিতর্ক রয়েই গেছে। বিশেষ করে বিগত তিনটি নির্বাচন আয়োজনে কমিশনের ভূমিকা সব মহলেই সমালোচিত। একতরফা নির্বাচন, রাতের ভোট এবং ডামি নির্বাচনের কলঙ্ক বহন করতে হয়েছে বিগত সরকার ও নির্বাচন কমিশনগুলোকে। পরিস্থিতি উত্তরণে সরকারের আন্তরিকতা, বিদ্যমান আইনের আমূল পরিবর্তন, রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা এবং সর্বোপরি ভোটারদের মানসিকতা পরিবর্তনের ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রয়োজনে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের স্থায়ী ব্যবস্থা চালু রাখার কথাও বলেছেন তারা, যা নির্বাচন কমিশন সংস্কারে গঠিত কমিশন গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে পারে। ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকার পতনের প্রায় মাস খানেক পর পদত্যাগ করেন কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এর পরই সাংবিধানিক গুরুত্বপূর্ণ এ প্রতিষ্ঠানটিতে শূন্যতা বিরাজ করছে। ফলে নতুন কমিশন গঠন নিয়ে এরই মধ্যে বিভিন্ন মহলে নানা আলোচনা শুরু হয়েছে। তার আগে নির্বাচন কমিশন সংস্কারে একটি কমিশন গঠন করে দিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া, কমিশনকে শক্তিশালীকরণ এবং সর্বোপরি একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ কী হতে পারে, তা নিয়েই কাজ করবে এ কমিশন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি অবাধ নির্বাচনের জন্য শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের বিকল্প নেই। সে জন্য নির্বাচন কমিশন নিয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি নিয়োগ প্রক্রিয়া সংস্কার এবং কমিশনের ক্ষমতাও বাড়াতে হবে। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারকের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের অনুসন্ধান কমিটি তথা সার্চ কমিটি গঠন করতে হয়। এ কমিটিতে আপিল বিভাগের একজন বিচারক ছাড়াও আর যারা থাকেন, তারা হলেন প্রধান বিচারপতি মনোনীত হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক; বাংলাদেশের মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক; বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতি মনোনীত দুজন বিশিষ্ট নাগরিক। তবে ওই দুই বিশিষ্ট নাগরিকের মাঝে একজন হবেন নারী। আইনে বর্ণিত যোগ্যতা-অযোগ্যতা বিবেচনা করে এই কমিটি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগদানের উদ্দেশ্য মোট ১০ জনের নাম প্রস্তাব করবে। অর্থাৎ, প্রতিটি শূন্য পদের বিপরীতে দুজন ব্যক্তির নাম সুপারিশ করবে তারা। ওই ১০ জনের মধ্য থেকেই পাঁচ জনকে নিয়ে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন রাষ্ট্রপতি। এ ক্ষেত্রে, কমিটি গঠনের ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে তাদের রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ পেশ করতে হবে। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর দেশে ১৩টি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়। এর মধ্যে ছয়জন সিইসিকে মেয়াদ শেষের আগেই বিদায় নিতে হয়েছিল। তাদের চারজন পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গ্রহণযোগ্যতার সংকটে বিদায় নেন। সরকারের কাজে অসন্তোষ থেকে পদত্যাগ করেন একজন। আর একজন স্বাস্থ্যগত কারণে বিদায় নিয়েছিলেন। সর্বশেষ মেয়াদ পাঁচ বছর হলেও তার আড়াই বছর গড়াতেই পদত্যাগ করে বিদায় নিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তিনি একাই নন, তার সহকর্মী অন্য চার নির্বাচন কমিশনারও পদত্যাগ করেছেন। আগে সরকারের ইচ্ছাতেই কমিশন গঠন করা হলেও নির্বাচন কমিশন নিয়োগে আইন পাস হওয়ার পর ২০২২ সালে গঠিত সর্বশেষ কমিশনটি পূর্ণ মেয়াদ শেষ করতে পারেনি। যদিও আইনটি নিয়ে সমালোচনা ছিল সবখানেই। আর যে সংসদে আইনটি পাস হয় সে সংসদও ছিল বিতর্কিত। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি এ কমিশনের অধীনেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হয়। বিরোধী দলগুলোর বর্জনের মুখে যে নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নিজেরাই নিজেদের মধ্যে ‘ডামি’ হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সেই নির্বাচনে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকার ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে মাত্র সাত মাসের মাথায় বিদায় নিলে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্বভার গ্রহণ করে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে সংস্কারের অংশ হিসেবে নির্বাচন কমিশন সংস্কারের জন্য এরই মধ্যে কমিশনও গঠন করে দিয়েছে সরকার। কাঙ্ক্ষিত সংস্কারের লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই সেই কমিশন অনানুষ্ঠানিকভাবে তৎপরতা শুরু করে দিয়েছে। তার আগে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বর্জনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে থেকেই একতরফা নির্বাচন আয়োজন করে কমিশন। আর ২০১৮ সালে নানা প্রতিশ্রুতির পর বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে আনা হলেও প্রশাসনের সহযোগিতায় ভোটের আগের রাতেই সারা দেশে ব্যালট বক্স ভরে নেন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা, যা নিয়ে এখনো বিতর্ক চলছে। ওই সরকার এবং নির্বাচন কমিশনকে রাতের সরকার ও রাতের কমিশন বলেও তকমা দেওয়া হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সংবিধান এবং আইনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনকে কিছু ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে। তবে অতীতে বিভিন্ন সময় দেখা গেছে নির্বাচন কমিশন এমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, যাতে ক্ষমতাসীনরা অসন্তুষ্ট হতে পারে। আরেকটু সহজ করে বললে, অতীতের কমিশনগুলো নিজেদের শপথ ও সাংবিধানিক দায়িত্ব ভুলে ক্ষমতাসীন দলের এজেন্ডাই বাস্তাবায়নে তৎপর ছিল। তবে কয়েকটি ক্ষেত্রে অবশ্য তার ব্যতিক্রমও ঘটেছে। নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা সম্পর্কে সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদে বলা আছে, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা নিশ্চিত ও সুরক্ষিত করা আছে। কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী যদি সরকার কাজ না করে তাহলে আইনের বরখেলাপ হবে। এ ছাড়া গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের মাধ্যমে নির্বাচন-সংক্রান্ত আইন এবং নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা আরও স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে। তপশিল ঘোষণার পর আইন অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন চাইলে প্রশাসনের মধ্যে রদবদল আনতে পারে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে বলা হয়েছে, নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পর থেকে বিভাগীয় কমিশনার, মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার এবং তাদের অধস্তন কর্মকর্তাদের নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া বদলি করা যাবে না। অন্যদিকে নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে বদলি করার প্রয়োজন হলে নির্বাচন কমিশন লিখিতভাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাবে। এরপর যত দ্রুত সম্ভব সে বদলি কার্যকর করতে হবে। তবে সংবিধানের এ অনুচ্ছেদ ও গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ নির্বাচন কমিশনকে যেমন ক্ষমতা দিয়েছে তেমনি আবার আইনে অস্পষ্টতাও রেখে দিয়েছে। কারণ, কোনো নির্বাচন কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী কোনো কর্মকর্তাকে বদলি করা কিংবা না করা হলে সেক্ষেত্রে কমিশন কী করতে পারে, এটা নিয়ে সরাসরি আইনে কিছুই বলা নেই। সংবিধানে বলা আছে, নির্বাহী বিভাগ নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করবে; কিন্তু যদি না করে বিষয়টি নিয়েও সুস্পষ্টভাবে কিছু বলা নেই। আর এ সুযোগটিই কাজে লাগিয়েছে অতীতের বিভিন্ন সরকার। যেমন ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কমিশন নির্বাচনের দুদিন আগে থেকে সেনাবাহিনী মোতায়েন করার জন্য সশস্ত্র বাাহিনী বিভাগকে চিঠি দিলেও তাতে সায় দেয়নি সরকার। বিষয়টি নিয়ে তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা খানিকটা হতাশাও প্রকাশ করেছিলেন। আসলে নির্বাচন কমিশনের সীমাবদ্ধতা কোথায় জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন বলা হলেও আসলে বাস্তবে কমিশনের হাত-পা বাঁধা। কারণ, কোনো দলকে জোর করে নির্বাচনে আনার দায়িত্ব কমিশনকে দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া প্রচলিত আইনের মাধ্যমে কমিশনকে এক ব্যক্তির প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। আইনে বলা আছে সচিবের মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে কমিশন দায়বদ্ধ থাকবে। এতে বাস্তবে অন্য কমিশনারদের তেমন ভূমিকা থাকে না। পাশাপাশি সংবিধানের ৩৯ ধারা এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের কোনো কোনো ধারা এখনো সুষ্ঠু নির্বাচনে অন্তরায় হয়ে আছে। ফলে একটি স্বাধীন কমিশন চাইলে প্রচলিত আইনগুলোর সংশোধন ও পরিমার্জন করতে হবে। পাশাপাশি রাজনৈতিক দল এবং জনগণকেও সচেতনভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। কোনো সন্ত্রাসী বা বিতর্কিত ব্যক্তি যাতে মনোনয়ন না পান, দলগুলোকে সেটি নিশ্চিত করতে হবে।’ কোন কোন কমিশন ভালো নির্বাচন উপহার দিয়েছে এবং সেটি কীভাবে, জানতে চাইলে এ কমিশনার বলেন, কেউ পেরেছে সত্যি। কারণ তখনকার সরকারও সহায়ক ছিল; কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি সেই নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী হয়ে আবার রাজনৈতিক দলই কমিশনকে নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন পাস করেছে। সেজন্য প্রয়োজনে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের স্থায়ী পদ্ধতি নিশ্চিত করতে হবে। কোনো দল নির্বাচিত হয়ে সেটি যাতে পরিবর্তন করতে না পারে, সেই বন্দোবস্ত করতে হবে। নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল আলীম বলেন, যে প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে, সেটি হতে হবে স্বচ্ছ। অর্থাৎ সার্চ কমিটি প্রাথমিকভাবে কাদের নাম প্রস্তাব করেছে এবং শেষ পর্যন্ত কাদের নিয়োগ করা হয়েছে, সেটি জনগণের জানা উচিত। প্রাথমিক তালিকা পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে জনগণ জানতে পারবে। তবে বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন আইন অনুযায়ী সার্চ কমিটি যেসব নাম প্রস্তাব করে সেগুলো সম্পর্কে মানুষের কোনো ধারণা থাকে না। তিনি আরও বলেন, নির্বাচন গঠনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কিছু গাইডলাইন আছে। বিভিন্ন দেশে এসব গাইডলাইন কিংবা রীতি অনুসরণ করা হয়। আর সার্চ কমিটিতে যারা থাকবেন তারা হবেন নিরপেক্ষ। সার্চ কমিটি নিরপেক্ষ না হলে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করা যাবে না। যাদের নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ করা হবে তাদের বিষয়ে ব্যাপকভাবে অনুসন্ধান করা দরকার। তাদের অতীত কেমন, পেশাগত জীবন কেমন ছিল ইত্যাদি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।