বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন ভূঁইয়া। অবসরপ্রাপ্ত এই প্রবীণ সেনা সদস্যের জীবনের দীর্ঘ সময় কেটেছে প্রবাসে। যখন হাতে লেখা চিঠির যুগ। প্রবাসে বসে দেশে স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মনের ভাব প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম ছিল ‘ডাক বিভাগ’। চিঠি পাঠানো আর উত্তরের অপেক্ষায় চেয়ে থাকতেন তিনি। এখন আর অপেক্ষায় থাকতে হয় না। মুহূর্তেই প্রিয়জনের সঙ্গে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ভিডিও কলে কথা বলা যায়। তাই তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে ডাক বিভাগের কার্যক্রম টিকে আছে শুধু লেনদেন আর পার্সেল সার্ভিসে। তাও নানা সংকট আর সীমাবদ্ধতায় গ্রাহক সেবা থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘ডাক’ বিভাগ। তবে ঐতিহ্যের এই ডাক বিভাগ টিকিয়ে রাখতে গণমুখী সিদ্ধান্ত গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন গ্রাহকরা। তথ্যমতে, খুলনা পোস্টমাস্টার জেনারেলের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে বরিশাল নগরীর ফজলুল হক অ্যাভিনিউ সড়কে অবস্থিত প্রথম শ্রেণির বরিশাল ‘প্রধান ডাকঘর’। এ ছাড়া ভোলা, পিরোজপুর ও ঝালকাঠি জেলায় রয়েছে বি-গ্রেডের তিনটি প্রধান ‘ডাকঘর’। এর বাইরে ২২টি উপজেলা ডাকঘর, ৪০টি উপ-ডাকঘর এবং ৪৯৫টি শাখা ডাকঘর রয়েছে। একসময় চিঠি আদান-প্রদানের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে জনপ্রিয় ছিল ডাকঘরগুলো। এই জনপ্রিয়তায় প্রথম ধাক্কা লাগে ১৯৯০ সালের জানুয়ারিতে। ওই সময় দেশব্যাপী সর্বাধুনিক টেলিসেবা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার চালু করেছিল ডিজিটাল টেলিফোন ব্যবস্থা। এর তিন বছর পর যোগাযোগ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনে মোবাইল ফোন সিটিসেল। সেই থেকেই প্রভাব আসতে শুরু করে ডাক বিভাগের ওপর। এরপর পর্যায়ক্রমে টেলিটক, রবি এবং গ্রামীণফোন মোবাইল সেবা চালু করে। আর এ মোবাইল ফোন বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে দেশের যোগাযোগ ক্ষেত্রে। ধীরে ধীরে শূন্যের ঘরে নেমে আসে চিঠি আদান-প্রদান। বর্তমানে সরকারি দপ্তর ছাড়া আর কারও চিঠি আসছে না ‘ডাকঘরে’। বরিশাল প্রধান ডাকঘরে কর্মরত ডাকপিয়ন শহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘একটা সময় ছিল যখন প্রতিদিন অন্তত ৩০০ থেকে ৪০০ চিঠি পৌঁছে দিতে হতো। যার মধ্যে দুই-তৃতীয়ংশই ছিল পারিবারিক চিঠি। তখন চিঠি বেশি হলেও কাজ করে অনেক আনন্দ পেতাম। চিঠি পৌঁছে দিয়ে নতুন বউয়ের মুখে হাসি দেখে অনেক আনন্দ পেতাম। তা ছাড়া তখন চিঠি মানুষের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিতে হতো না। গ্রামের বাজারে নির্দিষ্ট একটি দোকানে চিঠি রেখে এলেই হতো। বর্তমানে চিঠি কমে গেলেও এখন আর শান্তি নেই। কোনো কোনো সময় ৫০টি চিঠি বিলি করতেই দিন শেষ হয়ে যায়। আবার কখনো দুই থেকে তিন দিন ঘুরে চিঠি পৌঁছে দিতে হয়। বরিশাল প্রধান ডাকঘরের সহকারী পোস্টমাস্টার জেনারেল মো. আব্দুর রশিদ বলেন, ডাক বিভাগের কার্যক্রম শুধু চিঠির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বর্তমানে ডিজিটাল লেনদেনেও বড় ভূমিকা রাখছে। ব্যাংকিং সেক্টরের মতোই কার্যক্রম পরিচালনা করছে ডাক বিভাগ। এখানে আমানত জমা, জীবন বীমা এবং টাকা পৌঁছে দেওয়ার কাজ করা হয়। বর্তমানে বরিশাল প্রধান ডাকঘরে প্রতি মাসে দেড় থেকে ২০০ কোটি টাকা ট্রানজেকশন হচ্ছে। তা ছাড়া স্বল্প খরচে দেশে-বিদেশে পার্সেল সার্ভিসও দিচ্ছে ডাক বিভাগ। বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে বিদেশে একটি পার্সেল পাঠাতে ১০০ টাকা খরচ হলে সেখানে ডাক বিভাগের মাধ্যমে পাঠালে খরচ হচ্ছে অর্ধেকের কম। দেশের মধ্যে যে কোনো স্থানে ২৮ টাকায় পার্সেল পৌঁছে দেওয়া হয় নির্ভয়ে, নিশ্চয়তার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এত সুবিধার পরও সরকারি পার্সেল সার্ভিসে গ্রাহক কম। আর লেনদেনেও এখন কমে যাচ্ছে। এর কারণ পার্সেল সার্ভিস থাকলেও এ বিষয়ে প্রচারের যথেষ্ট অভাবে রয়েছে। যে কারণে অনেক মানুষ জানেই না ডাক বিভাগের পার্সেল সার্ভিসের কথা। তা ছাড়া লেনদেনের ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ডাকঘরে একজন ব্যক্তি একটির বেশি হিসাব খুলতে পারবে না। আবার ৫ লাখের বেশি টাকা রাখতে হলে ‘টিআইএন’ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এক্ষেত্রে নিম্ন শ্রেণির মানুষ ডাকঘরে টাকা রাখছে না। আবার পূর্বে একজন ব্যক্তি একাধিক স্থানে হিসাব খুলতে পারলেও এখন আধুনিকায়নের কারণে সেই সুযোগ পাচ্ছে না। মূলত এসব কারণে ডাক বিভাগে গ্রাহক কমছে।