সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের লক্ষ্যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতাকে ‘নির্বিচারে হত্যার’ অভিযোগে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ এবং দলটির নিবন্ধন বাতিলের দাবি জোরালো হচ্ছে। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলে আওয়ামী লীগের প্রায় সব নেতাকর্মী আত্মগোপনে চলে যান। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর পরও বিভিন্নভাবে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছেন দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। তবে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে কঠোর মনোভাবও পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট—তাদের (আওয়ামী লীগ) রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করবে। এ ছাড়া গত রোববার এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগকে আইনগতভাবে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক কয়েকটি বিবৃতি এবং সাংগঠনিক তৎপরতার কিছু ঘটনায় বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। দলগুলোর নেতারা বলছেন, যেভাবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণ করেছে, ছাত্র-জনতাকে গুম এবং হত্যা করেছে, আর্থিক খাতে সীমাহীন লুটপাট ও দখলদারিত্ব করেছে, তাতে করে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে। সর্বশেষ গত শনিবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সংলাপে কয়েকটি দলের নেতারা প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার প্রস্তাবনা দেন। অবশ্য সম্প্রতি ঢাকার প্রেস ক্লাবের সামনে, সাভার, পাবনা, মুন্সীগঞ্জ, নড়াইলসহ বেশ কয়েকটি জেলায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাকর্মীদের মাঝে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। গত ২৯ আগস্ট আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ চেয়ে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেছিলেন ‘সারডা সোসাইটি’ নামের একটি মানবাধিকার সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক আরিফুর রহমান মুরাদ ভূঁইয়া। যদিও রিটটি খারিজ করে দেন আদালত। তবে মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আওয়ামী লীগের গণহত্যার বিচার হবে বলে জানা গেছে। ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের একতরফা ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান। সেদিনই আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়, নেতাকর্মীদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট অগ্নিসংযোগ শুরু হয়। দলটির শীর্ষ কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হলেও বেশিরভাগ নেতাকর্মী এখন আত্মগোপনে। আওয়ামী সরকারের ১৫ বছরের দুঃশাসনে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে অনেক কথা বলা হলেও সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, ব্যাংক খাতে লুটপাট, দুই অঙ্ক ছুঁই ছুঁই মূল্যস্ফীতি, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন, মতপ্রকাশের অধিকার ও বাকস্বাধীনতা হরণ এবং রাষ্ট্রের সবক্ষেত্রে দলীয়করণের বিস্তর অভিযোগে নাগরিকদের বিভিন্ন অংশের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়, যার প্রকাশ ঘটে সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনে। আওয়ামী লীগে পতনের পর রাজনৈতিক মহলসহ বিশিষ্টজন কেউ কেউ আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিষিদ্ধ করার দাবি জানান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. এম শাহীদুজ্জামান গত শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, আওয়ামী লীগকে আর রাজনৈতিক দল হিসেবে আমরা দেখতে চাই না। এদের বিচার হবে, ফাঁসি হবে। এটাকে রাজনৈতিক দল বলা যায় না। এটা ফ্যাসিস্ট দল। আওয়ামী লীগ হচ্ছে সন্ত্রাসী সংগঠন। এটাকে শেষ করে দেওয়া উচিত। যারা আওয়ামী লীগ সমর্থন করেন, তারা ফ্যাসিজমে বিশ্বাস করেন। তাদের কোনো অনুশোচনা নেই। তারা আবার সুযোগ পেলে মরণ কামড় দেবে। অতএব আওয়ামী লীগকে আমরা কোনোভাবেই একটা রাজনৈতিক দল হিসেবে মেনে নিতে পারি না। এদিকে সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে গত শনিবার ১০টি রাজনৈতিক দল ও জোটের শীর্ষ নেতা এবং প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সংলাপ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। পরে রাতে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখার বিষয় সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, যারা গত তিনটি নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, অবৈধভাবে নির্বাচিত হয়ে তারা জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট—তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করবে। কীভাবে বাধা দেওয়া হবে, সে বিষয়ে তিনি বলেন, এটার আইনি ও প্রশাসনিক দিক আছে। যখন নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু হবে, তখন বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে মাহফুজ আলম বলেন, আওয়ামী লীগ বা ১৪ দল নিষিদ্ধের বিষয়টি সরকার পর্যালোচনা করছে। সব রাজনৈতিক দল এবং সব ধরনের অংশীজনের (স্টেকহোল্ডার) সঙ্গে পরামর্শ করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সরকার একা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে না। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু গতকাল রোববার বলেন, আওয়ামী লীগ সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট করা হয়েছে। আমরা বলেছি, আমাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শহীদ জিয়ার হাত ধরেই আওয়ামী লীগের পুনর্জন্ম। নিষিদ্ধ করার প্রয়োজন হলে তিনি তখনই আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করতেন। সুতরাং আমরা শহীদ জিয়ার আদর্শে বিশ্বাসী। তবে আওয়ামী লীগ যেভাবে গুম-হত্যা এবং নির্যাতন নিপীড়ন চালিয়েছে, সেজন্য গণহত্যার দায় তাদের নিতে হবে। হত্যাকাণ্ডের দায়ে তাদের বিচার অবশ্যই হতে হবে। লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বলেছেন, আমরা পুরো জাতি জুলাই-আগস্টে একটা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে গেলাম। এই যুদ্ধটা কার বিরুদ্ধে হলো, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা কেন হলো? তারা অন্যায়ভাবে পুলিশকে ব্যবহার করেছে, প্রশাসনকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করেছে। দেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে, দেশ দুর্নীতিগ্রস্ত হয়েছে। জুলাই-আগস্টে আমাদের বহু ছেলেমেয়ে হতাহত হয়েছে। দেড় হাজারের ওপরে আমাদের ছেলেমেয়ে মারা গেছে। অনেকে বলে আরও বেশি হবে, যার কোনো হিসাব নেই। অনেক লাশ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। ১৫ থেকে ২০ হাজার মানুষ বিভিন্নভাবে আহত হয়েছে। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে জামায়াত মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। সেদিন আমরা তাদের নিষিদ্ধ করেছিলাম। আজকে কী কারণে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হবে না? আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে। কারণ, আওয়ামী লীগ ১৮ কোটি মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। তাদের রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই। তারা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সবাইকে ব্যবহার করেছে। শেষ পর্যন্ত তারা জনতার চাপে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। গণহত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়া শেখ হাসিনা প্রসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, পতিত স্বৈরাচার বসে নেই। একটি প্রতিবেশী দেশ স্পষ্ট ভাষায় বলছে, শেখ হাসিনা সেখানে (ভারত) আছেন। শেখ হাসিনা সর্বশ্রেষ্ঠ শীর্ষ সন্ত্রাসী, খুনি। যে শিশুর রক্ত পান করতে পারে, তার মতো শীর্ষ সন্ত্রাসী আর কে হতে পারে? তাকে (শেখ হাসিনা) আশ্রয় দেওয়া মানে অপরাধকে আশ্রয় দেওয়া, অন্যায়কে আশ্রয় দেওয়া, খুনিকে আশ্রয় দেওয়া। রিজভী বলেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশে বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি আছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে কূটনৈতিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে প্রত্যর্পণ বিষয়টি সমাধান করতে পারে। তাকে ফিরিয়ে আনতে পারে। তা না হলে বাংলাদেশে যত শীর্ষ সন্ত্রাসী আছে, তারা সেখানে আশ্রয় পাওয়ার সুযোগ নেবে। বিভিন্ন দেশে এভাবে আশ্রয় পাওয়ার সুযোগ পাবে। ১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতি বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম যে বক্তব্য দিয়েছেন আমি মনে করি সেটি যথার্থই দিয়েছেন। কেননা, তিনি ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন সমন্বয়ক। তাদের চিন্তা-চেতনার জায়গা হলো—একটি নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা। সেখানে তো আওয়ামী লীগকে রাখার প্রশ্নই আসে না। এহসানুল হুদা আরও বলেন, আওয়ামী লীগ গত ১৫ বছরে দেশে এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি চালু করেছিল। সেখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, যারা আওয়ামী লীগকে রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়ার বিষয়ে কথা বলেন আমি তাদের বলি, একটি দল কী কী করলে তাকে নিষিদ্ধ করা যাবে? কেননা আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান দলীয়করণ করেছে। পুলিশ-প্রশাসন, ডিজিএফআই, এনএসআইকে তারা দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহার করেছে। দেশ থেকে অসংখ্য মানুষের টাকা তারা বিদেশে পাচার করে দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করে দিয়েছে। সবমিলিয়ে আমি মনে করি, আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই।