ট্রাফিক পুলিশ ফিরলেও গতি ফেরেনি সড়কে

প্রকাশিতঃ অক্টোবর ২২, ২০২৪ | ৯:০৮ পূর্বাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

সড়কে ট্রাফিক পুলিশ ফিরলেও তাদের কাজে গতি ফেরেনি। এ কারণে নেই কোনো শৃঙ্খলার বালাই। যে যেভাবে পারছেন, চালাচ্ছেন যানবাহন। ব্যাটারিচালিত রিকশা উঠে এসেছে প্রধান সড়কে, এমনকি চলছে ফ্লাইওভার দিয়েও। ভারী যানবাহন দিনে চলাচল নিষিদ্ধ থাকলেও চলছে সকাল থেকেই। ফলে নগরীর যানজট পরিস্থিতি আরও তীব্র আকার ধারণ করছে। আর ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা বলছেন, তারা এখনো আগের মতো অ্যাকশনে যেতে পারছেন না। এদিকে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে দেখা গেছে নিয়ম ভাঙার চিত্র। পরিস্থিতি এমন যে—অধিকাংশ পরিবহন চালক সড়ক আইন মানতে নারাজ। তারা যে যেভাবে পারছেন দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে গাড়ি চালাচ্ছেন। আর ট্রাফিক পয়েন্টগুলোর অনেক স্পটেই ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। কুড়িল বিশ্বরোড সড়কে ব্যাটারিচালিত এক রিকশাচালকের কাছে জানতে চাওয়া হয় প্রধান সড়কে চলে এসেছেন, কিন্তু পুলিশ বাধা দেয় না কেন? জবাবে তিনি বলেন, ‘কে বাধা দেবে? এটা স্বাধীন রাষ্ট্র, আমরা এখন স্বাধীন। তাই স্বাধীনভাবে গাড়ি চালাইয়া খাই।’ খিলক্ষেত এলাকায় এক ট্রাকচালককে দিনের বেলা ট্রাক চালানো সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, সবাই চালাচ্ছে, আমিও চালাচ্ছি। এখন কোনো বাধা নেই। রাত ১০টার পর ভারী যান চলাচলের নিয়ম সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ওইটা ছিল স্বৈরাচারের নিয়ম। এখন নতুন বাংলাদেশ। এখন আগের এসব নিয়মকানুন নেই। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) খোন্দকার নজমুল বলেন, বিভিন্ন দাবিতে প্রায় সময় সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করা হয়। এতে যানজট পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেয়। এ ছাড়া নগরীতে প্রায় ৪০ হাজার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা সড়কে উঠে এসেছে। ভারী যানবাহন দিনের বেলায় চলতে শুরু করেছে—এগুলোও যানজটের অন্যতম কারণ। তিনি বলেন, আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। আস্তে আস্তে মামলায় যাচ্ছি। প্রতিদিন আড়াই থেকে তিনশ মামলা হচ্ছে নগরীতে। যদিও আগে প্রতিদিন ১ হাজার থেকে ১২০০ মামলা হতো। পর্যায়ক্রমে ব্যাটারিচালিত রিকশা এবং দিনে চলা ভারী যানবাহন সড়কে চলতে দেওয়া হবে না। তিনি যানজট নিরসন এবং সড়ক আইন মেনে ট্রাফিক পুলিশকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান সাধারণ মানুষের প্রতি। এদিকে বিজয় সরণি মোড়ে একজন ট্রাফিক সদস্য ব্যাটারিচালিত একটি রিকশাকে ঘুরিয়ে দিতে চাইলে চালককে ট্রাফিক পুলিশের উদ্দেশে বলতে শোনা যায়, আপনাদের আগের পাওয়ার আর নেই। বেশি বাড়াবাড়ি করলে ছাত্র ডাক দেব, বলব ঘুষ চাইছেন। এরপর তো কী হবে বোঝেনই। ওই ট্রাফিক সদস্য কথা না বাড়িয়ে ফিরে যান। তিনি বলেন, এমন পরিস্থিতির মধ্যে প্রতিদিনই আমাদের পড়তে হচ্ছে। পেটের তাগিদে চাকরি করি। বিকল্প উপার্জনের ব্যবস্থা থাকলে চাকরিই ছেড়ে দিতাম। অন্যায়ভাবে মানুষের কটু কথা আর নিতে পারি না। বুয়েটের এক গবেষণায় জানা যায়, ঢাকার যানজটের কারণে প্রতিদিন গড়ে ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। প্রতি কর্মঘণ্টার মূল্য ৫০ টাকা ধরে ৩৬৫ দিন বা বছরে নষ্ট হচ্ছে ১৪ হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা। যানজটের কারণে বছরে ১.৬৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ২০ হাজার ১৬০ কোটি টাকার বাড়তি তেল আমদানি করতে হয়। অন্যদিকে কর্মঘণ্টা নষ্ট হওয়ার কারণে যদি ২০ শতাংশ কর্মদক্ষতা কম হয় এবং এর জন্য দিনে ৩০ কোটি টাকার কাজ কম সম্পাদন হয়, তাহলে বছরে ১০ হাজার ৯৫০ কোটি টাকার কম কার্য সম্পাদিত হচ্ছে। এই তিনটি ক্ষতিকে এক করলে বছরে ৪৬ হাজার ৭৫ কোটি টাকা বা ৩.৮৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষতি হচ্ছে। এদিকে সড়কে বিশৃঙ্খলার কারণে সোমবারও নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ছিল যানজট। গরম আর যানজটে রীতিমতো গলদঘর্ম হতে হচ্ছে মানুষকে। উত্তরা, হাউস বিল্ডিং, এয়ারপোর্ট, প্রগতি সরণি, লিঙ্ক রোড, গুলশান-১, রামপুরা, হাতিরঝিল, কাকরাইল, কাকলী, বনানী, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, ধানমন্ডি, আসাদগেটসহ নগরীর প্রায় প্রতিটি পয়েন্টেই যানজট লেগে থাকে। যানজটের অন্যতম কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা দায়ী করছেন, ট্রাফিক পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং ও যাত্রী ওঠানামা, সঠিক লেন না মেনে গাড়ি চালানো, সড়কে মানুষের চলাচল, ফুটপাত দখল, হঠাৎ বৃষ্টির জন্য জলাবদ্ধতা, রিকশা-অটোরিকশা-মোটরসাইকেলের নিয়মহীন চলাচল, ভাঙা ও সরু রাস্তা ইত্যাদিকে। ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হানিফ খোকন বলেন, ফ্যাসিবাদী হাসিনার পতনের পর বেশ কিছুদিন রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ ছিল না। সেই সুযোগে ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকা থেকে প্রায় সাড়ে তিন লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা ঢাকায় প্রবেশ করেছে। এসব রিকশা এতটাই বেপরোয়া যে, তারা এয়ারপোর্ট রোডেও চলতে দ্বিধা করছে না। তিনি বলেন, কয়েকদিন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতেও এসব রিকশা উঠতে দেখা গেছে। যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের টোলপ্লাজায় আগুন দেওয়ার ঘটনার পর ফ্লাইওভার দিয়েও ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক চলাচল করতে দেখা গেছে। এখন নগরীর সব রাস্তায় এসব নিষিদ্ধ যান অবাধে চলাচল করছে। এগুলোই মূলত যানজটের সৃষ্টি করে মানুষের ভোগান্তি বাড়াচ্ছে। দ্রুত এসব নিষিদ্ধ যান চলাচল বন্ধ করতে না পারলে রাজধানীতে এরা ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে জনজীবন স্থবির করে দেবে। হাসিনা সরকার পতনের পর পুলিশ এবং সাধারণ জনগণের মধ্যকার সম্পর্কে ব্যাপক টানাপোড়ন পড়ে। আর এতে করে বেশ কিছুদিন কর্মবিরতির পর সড়কে পুলিশ নামলেও তাদের মধ্যে আগের মতো কর্মস্পৃহা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না, এমনটাই অভিযোগ করছেন নগরবাসী। নগরীর বাসিন্দাদের অভিযোগ, পুলিশ যদি আগের মতো সড়কে কাজ না করে তবে এ যানজট দিনকে দিন বেড়েই চলবে। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আরেফিন বলেন, সড়কে দিনকে দিন যানজট বেড়েই চলছে। পর্যাপ্ত ট্রাফিক পুলিশ সড়কে যেন থেকেও নেই। তারা আগের মতো ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে না। অনেকটা নীরব দর্শকের মতো দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলামটর এলাকায় দায়িত্বরত একজন ট্রাফিক সদস্য বলেন, আমরা যানজট নিরসনে প্রাণপণ চেষ্টা করছি। কিন্তু অনেকেই আমাদের কথা শুনতে চান না। পাল্টা নানা অজুহাতে ধমক দেন।