জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের শাসনক্ষমতা এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতে। সরকার এই অভ্যুত্থানের স্মৃতি ধরে রাখতে চায়। এই ভাবনা থেকেই পাঠ্যবইয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বিভিন্ন বিষয় স্থান পাচ্ছে। প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবইগুলোর পেছনের প্রচ্ছদে যুক্ত হচ্ছে অভ্যুত্থানের গ্রাফিতি বা দেয়ালে আঁকা ছবি এবং ক্যালিগ্রাফি। সেই জায়গায় এত দিন ধরে স্থান পাওয়া ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্ধৃতি বাদ যাচ্ছে। পাঠ্যবইয়ের ভেতরের কাভারে আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নের প্রচার ও শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। এ ছাড়া, বইয়ে জুলাই বিপ্লবের ঘটনাপ্রবাহ অধ্যায় বা অনুচ্ছেদ আকারে থাকতে পারে। এর বাইরে পুলিশের গুলিতে মারা যাওয়া আবু সাঈদ ও মীর মুগ্ধর জীবনী রাখার বিষয়েও প্রাথমিক আলোচনা সেরেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। বাদ যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাসের নায়কদের অতিরঞ্জিত ইতিহাস। যার যতটুকু অবদান, সেটুকুই স্থান পাচ্ছে। সে কারণে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়টি পাঠ্যবইতে যুক্ত হচ্ছে। আবার এতদিন রাজনীতিতে নারীর অবদানের জায়গায় খালেদা জিয়াকে অস্বীকার করা হলেও এবার বইয়ে তার নাম যুক্ত হচ্ছে। একই সঙ্গে ইতিহাসনির্ভর বিষয়েও অনেক পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এনসিটিবি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এনসিটিবি সূত্র বলছে, আগামী বছর প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে পাঠ্যবই দেওয়া হলেও সেখানে কিছু পরিমার্জন হচ্ছে। তবে চতুর্থ থেকে দশম শ্রেণির পাঠ্যবই পুরোনো শিক্ষাক্রমের আলোকে দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যবই দেওয়া হবে ২০১১ সালের শিক্ষাক্রমের আলোকে। আর ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ২০১২ সালে প্রণীত শিক্ষাক্রমের আলোকে তৈরি পাঠ্যবই পাবে শিক্ষার্থীরা। আগামী বছর পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম চূড়ান্ত করে ২০২৬ সাল থেকে তা কার্যকর করা হবে। এনসিটিবি সূত্র বলছে, পাঠ্যবইয়ের বিশেষ করে বাংলা, ইংরেজি, ধর্ম এবং বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বইয়ের পেছনে গ্রাফিতি থাকছে। ধর্ম বইয়ের পেছনে বাংলা ক্যালিগ্রাফি থাকতে পারে। অন্যদিকে, মাদ্রাসার বিশেষায়িত বইগুলোর পেছনে থাকতে পারে আরবি ক্যালিগ্রাফি। গ্রাফিতির বাইরে প্রচ্ছদে কোরআনের আয়াত বা হাদিসের বাণী থাকতে পারে। এনসিটিবির সম্পাদনা শাখার তথ্য মতে, গ্রাফিতির বাইরেও গণঅভ্যুত্থানের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে একটি কনটেন্ট থাকতে পারে। এ ছাড়া, অভ্যুত্থানে শহীদ আবু সাঈদ ও মীর মুগ্ধর জীবনীও রাখা হতে পারে। তবে, সবকিছুই নির্ভর করছে সময়ের ওপরে। জানতে চাইলে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের স্মৃতি হিসেবে গ্রাফিতি যুক্ত করার বিষয়টি মোটামুটি চূড়ান্ত করা হয়েছে। তবে অভ্যুত্থানে শহীদদের জীবনী এখনই সংযুক্ত করা হবে কি না, সেটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। বিষয়টি নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে স্বীকার করে তিনি বলেন, এই স্বল্প সময়ে সেটি লেখা যাবে কি না, তা এখনো নিশ্চিত নয়। যেহেতু বইয়ের কাজে আমরা কিছুটা পিছিয়ে আছি। অল্প সময়ের মধ্যে তাদের জীবনী লেখা প্রস্তুত করা গেলে এটি যুক্ত হতে পারে। নয়তো পরিকল্পনা থেকে বাদ দেওয়া লাগতে পারে। সূত্র বলছে, আগামী বছরের পাঠ্যবইয়ে জিয়াউর রহমান কীভাবে, কোন পরিস্থিতিতে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন তার তথ্য সন্নিবেশিত হবে। এ ছাড়া, শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে যতটুকু অবদান তাও লেখা থাকবে। বিগত সরকারের সময় পাঠ্যবইয়ে রাজনীতিতে নারীর অবদান অংশে শেখ হাসিনা, শিরীন শারমিন চৌধুরী বা দীপু মনির অবদান লেখা হলেও খালেদা জিয়ার নাম নেই। সে কারণে আগামী বছরের বইয়ে তার নাম যুক্ত হচ্ছে। এ ছাড়া, বিগত সরকারের সময় সুবিধাভোগী ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের নাম বইয়ের রচনা ও সম্পাদনা থেকে বাদ যাচ্ছে। এনসিটিবির একজন ঊর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, বিগত সরকারের সময় শেখ মুজিবুর রহমানের ইতিহাস ও অবদান লিখতে গিয়ে অতিরঞ্জিত করা হয়েছে। সেজন্য মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে তার যতটুকু অবদান তা লেখা থাকবে। তার ৭ মার্চের ভাষণও থাকবে। তাকে একেবারেই মুছে ফেলা হচ্ছে না। তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরে ২৭ মার্চ তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের হয়ে ফের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এই বিষয়টি বইয়ে স্থান পাবে। রাজনীতিতে নারীদের অবদান অংশে খালেদা জিয়ার নামও যুক্ত হচ্ছে। সূত্র বলছে, প্রাথমিকে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির বইয়ে তেমন পরিবর্তন হচ্ছে না। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বইয়ে নির্ভুল বানান, কিছু নতুন লেখা সংযুক্ত হচ্ছে। বিশেষ করে তৃতীয় শ্রেণির প্রশ্ন পদ্ধতিতে কিছু পরিবর্তন আনা হচ্ছে। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে বেশকিছু বিষয় পরিমার্জন হচ্ছে। এসব বইয়ে আল মাহমুদ, ফররুখ আহমদের কবিতা রাখা হচ্ছে। তবে একাদশ শ্রেণির বাংলা বই থেকে মুহাম্মদ জাফর ইকবালের ‘মহাজাগতিক কিউরেটর’ শিরোনামের লেখা বাদ যাচ্ছে। পাশাপাশি বিজ্ঞান বিষয়ের অন্য বই থেকেও জাফর ইকবালের সব লেখা বাদ দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে একাদশের বাংলা বইয়ে বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘বায়ান্নর দিনগুলো, বাদ যাচ্ছে। তবে ইংরেজি বইয়ে ৭ মার্চের ভাষণ ঠিক থাকছে। সেইসঙ্গে মার্টিন লুথার কিং ও নেলসন ম্যান্ডেলার বিখ্যাত ভাষণও থাকছে। এনসিটিবির তথ্য মতে, চলতি বছর সব শ্রেণিতে ৪০ কোটির বেশি বই ছাপা হচ্ছে। যার মধ্যে প্রাথমিকে বইয়ের সংখ্যা ১২ কোটি ৮ লাখ ৬৭ হাজার ৭৫২ এবং মাধ্যমিকের বই ২৮ কোটি ৬ লাখ ২২ হাজার ৩৩৭। এর মধ্যে ইবতেদায়ি ও ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর বইও যুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া ব্রেইল বই রয়েছে সাড়ে ৮ হাজার। তবে বছরের মাত্র দুই মাস বাকি থাকলেও এখনো পাঠ্যবই পরিমার্জনের কাজ শেষ করে ছাপার জন্য প্রস্তুত করতে পারেনি এনসিটিবি। ফলে বছরের শুরুতে সব শিক্ষার্থীর হাতে সব নতুন বই তুলে দেওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। একজন মুদ্রণকারী বলেন, কাগজের মিলের সিন্ডিকেট বন্ধ, ইন্সপেকশন এজেন্ট নিয়োগে সতর্কতা, গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে মনিটর, সেনাবাহিনীর হাতে বইয়ের কিছু অংশ ছাপার দায়িত্ব দেওয়াসহ বেশকিছু উদ্যোগের কারণে এবার ভালো মানের কাগজেই পাঠ্যবই যাবে বলে আশা করা যায়; কিন্তু বছরের শুরুতেই এই বই শিক্ষার্থীরা পাবে না। কারণ, স্বল্প সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে এনসিটিবির উচিত দ্রুত ছাপাখানাগুলোকে কাজ দেওয়া। সেটি হচ্ছে না। আবার একইসময়ে সব লটের কার্যাদেশ দেওয়া হলে ছাপাখানার ওপর চাপ বাড়বে। মিল মালিকগুলোরও এত সক্ষমতা নেই। এনসিটিবির তথ্য মতে, এখনো সব পাঠ্যবইয়ের পরিমার্জন শেষ না হলেও এরই মধ্যে প্রাথমিকের প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির সব বইয়ের পাণ্ডুলিপি চূড়ান্ত করে প্রেসে পাঠানো হয়েছে। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বইয়ের পাণ্ডুলিপির কাজ এক সপ্তাহের মধ্যে প্রেসে যাবে। তবে মাধ্যমিকে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির বইয়ের কাজ চলছে পুরোদমে। কবে নাগাদ এসব শ্রেণির বইয়ের পরিমার্জন শেষ হবে, তা এখনই জানাতে পারেনি এনসিটিবি। জানতে চাইলে এনসিটিবি চেয়ারম্যান বলেন, এরই মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির বই ছাপার জন্য প্রেসে পাঠানো হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্য শ্রেণির বইও যাবে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি, জানুয়ারি মাসেই শিক্ষার্থীদের হাতে পরিমার্জিত পাঠ্যবই পৌঁছানোর।