প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মানুষ ও গবাদি পশু রক্ষায় সারা দেশে স্থাপন করা হয় আশ্রয়কেন্দ্র। প্রকল্প প্রস্তাবনায় বলা হয়েছিল দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে এসব ভবন সামাজিক অনুষ্ঠান, কমিউনিটি উন্নয়নের জন্য ব্যবহার করা হবে। পাশাপাশি ভবনের সামনের খোলা জায়গা ব্যবহার করা হবে খেলাধুলায়। সরকার এই প্রকল্পের নাম দিয়েছিল ‘মুজিব কিল্লা নির্মাণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ প্রকল্প। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে দেশের ১৬ জেলায় ৫৫০টি মুজিব কিল্লা নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। এর জন্য ব্যয় ধরা হয় প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। সারা দেশে নির্মিত এসব কিল্লার বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এরই মধ্যে বেশিরভাগ কিল্লার নির্মাণকাজ শেষ। মানহীন সামগ্রী দিয়ে নির্মিত এসব কিল্লা এরই মধ্যে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। অনেক স্থানে ভেঙে গেছে। কিছু কিছু জায়গায় লোকালয় থেকে অনেক দূরে নির্মাণের কারণে পরিত্যক্ত ভবনে পরিণত হয়েছে। অনেকগুলোর ক্ষেত্রে লাইট-ফ্যান কিংবা অন্য প্রয়োজনীয় জিনিস দেওয়া হয়নি। এমনকি কিল্লা নদীতে ভেঙে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। সব মিলিয়ে পুরো প্রকল্পই প্রশ্নবিদ্ধ। কিল্লার উপকারভোগী যারা হবেন, তারা বলছেন, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে এসব কিল্লা আশ্রয়ের পরিবর্তে মরণফাঁদ হয়ে উঠতে পারে। যথাযথ সমীক্ষা ছাড়া এ ধরনের বিলাসী প্রকল্পে বিপুল টাকা ব্যয়কে স্রেফ গচ্চা হিসেবে দেখছেন বিশিষ্টজন। সরেজমিন স্থানীয় প্রতিনিধিরা দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা এসব মুজিব কিল্লা পরিদর্শন করেছেন। এতে উঠে এসেছে মুজিব কিল্লা নির্মাণে অনিয়ম এবং অর্থ তছরুপের চিত্র। দেখা গেছে, অধিকাংশ মুজিব কিল্লায় বসানো গভীর নলকূপের দুই-তৃতীয়াংশ বিকল হয়ে গেছে। মাটির কিল্লা সংরক্ষণে ব্যবহৃত ব্লক এবং ড্রেনেজ ব্যবস্থা ধসে গেছে। দেওয়া হয়নি ব্লকের নিচে জিও টেক্সটাইল। যথাযথ তদারকির অভাব এবং অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে অধিকাংশ অবকাঠামো ফাটল ধরে ধসে পড়ার উপক্রম হয়েছে। প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, এ প্রকল্পের কিল্লার নির্মাণের জায়গা নির্বাচন করেছেন স্থানীয় এমপিরা। ঠিকাদারি কাজের দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে এমপি অনুসারীদের। সিরাজগঞ্জের একটি মুজিব কিল্লা নির্মাণ শেষ হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই ভেঙে পড়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, কাজীপুর উপজেলার চর গিরিশ ইউনিয়নে যমুনা নদীর পানির স্রোতে কিল্লাটির একাংশ ভেঙে যায়। মূলত নতুন মাটি ফেলে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল। পটুয়াখালীর জেলার কলাপাড়ার পশ্চিম বাদুরতলী ও পূর্ব-টিয়াখালী এবং রাঙ্গাবালী উপজেলার কাউখালী ও কোড়ালিয়া গ্রামে কিল্লা নির্মাণে ঘটেছে অনিয়ম। এ দুই উপজেলায় নির্মিত আরও অনেক কিল্লার ভবনে ফাটলসহ ব্লক ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা ভেঙে গেছে। এই অঞ্চলে ৩৩টি কিল্লা নির্মাণ করা হবে। স্থানীয়রা বলছেন, জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড় থেকে সাগর উপকূলের গবাদি পশু এবং মানুষের জীবন রক্ষার জন্য এ কিল্লা নির্মাণ। কিন্তু এই অঞ্চলে যে কয়টি কিল্লা নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে, সবগুলোর অবস্থা ভঙ্গুর। অনেকগুলো মূল জায়গা থেকে সরে গেছে। কিছু কিছু কিল্লায় মাটির পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে ভিটি বালু। অনেক ভবনে ফাটল স্পষ্ট। জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ে এই কিল্লা মানুষের জন্য নিরাপদ নয়। উল্টো মরণফাঁদ হিসেবে দেখা যেতে পারে। এই অঞ্চলের বেশ কয়েকটি কিল্লা পরিদর্শন করে দেখা গেছে, অনিয়মের একই চিত্র। নিম্নমানের ইট দিয়ে কলাম তৈরি, পুরুত্ব কম, দুর্বল ব্লক, নিম্নমানের রড ও রডের কম ব্যবহারসহ নানা অসংগতি রয়েছে। আবার ভোলা জেলার সদর উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের মাঝের চরের বারাইপুর গ্রামে নির্মিত কিল্লাটি নির্মাণ করা হয় সমতল ভূমিতে বালু ফেলে। করা হয়নি কিল্লায় প্রবেশের রাস্তা। সামান্য বাতাসে ভবনের চারপাশের বালু উড়ে যাওয়ায় ধসে পড়ার আশঙ্কা করছেন এলাকাবাসী। পিরোজপুরের দাউদখালী ইউনিয়নে একটি কিল্লা নির্মাণে ৬০ ফুট গভীর পর্যন্ত পাইল বসানোর কথা থাকলেও সেখানে অনিয়ম করা হয়েছে। পাইল কম বসানো, রডের পরিমাণ কম, অপরিষ্কার পাথর দিয়ে ঢালাইসহ নানা অনিয়মের বিষয়টি স্থানীয়দের হাতে ধরা পড়ে। নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার ঝুনাগাছ চাপানী ইউনিয়নের ছাতুনামা গ্রামে একটি কিল্লা স্থাপন করা হয়। ২০২২ সালে এটি উদ্বোধনও করা হয়। এরপর দুই বছরে একটি একবারের জন্যও ব্যবহার করা হয়নি। স্থানীয়রা বলছেন, লোকালয় থেকে অনেক দূরে প্রায় ৫ বিঘা জমির ওপর এটি নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু কিল্লায় যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই। সোলার, ব্যাটারিসহ ১৪টি ফ্যান বরাদ্দ থাকলেও রয়েছে ছয়টি। যদিও গত দুই বছর এই অঞ্চলে বন্যা হয়ে পানিবন্দি ছিলেন এলাকাবাসী। এই কিল্লা ব্যবহারের অনুপযোগী থাকায় পানিবন্দি কেউ সেখানে আশ্রয়ে যাননি। সার্বিক বিষয়ে মুজিব কিল্লা নির্মাণ, সংস্কার ও উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) মো. মনোয়ার হোসেন (যুগ্ম সচিব) বলেন, মুজিব কিল্লা নির্মাণে ঢালাওভাবে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তোলা ঠিক হবে না। কিল্লার মান ঠিক রাখতে আমাদের কর্মকর্তারা নিয়মিতভাবে নির্মাণকাজ মনিটরিং করছেন। তার পরও কারও বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে আমরা তদন্ত সাপেক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা নেব। যদিও ‘মুজিব কিল্লা’ প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে ২০২১ সালের ৫ ডিসেম্বর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছিল। ওই বৈঠকে যত দ্রুত সম্ভব প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করার তাগিদ দেওয়া হয়েছিল। তার পরও নির্ধারিত সময়ে এ কাজ শেষ করতে পারেনি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। উল্টো প্রকল্পের মেয়াদ ও খরচ বাড়ানো হয়। জানা যায়, প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছিল ২০১৮ সালে। এরপর ২০২০ সালে শুরু হয় টেন্ডার প্রক্রিয়া। আগে শুধু উপকূলীয় জেলায় কিল্লা নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিলেও বর্তমানে বন্যাপ্রবণ এলাকায়ও তা নির্মাণ হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে ২০২৩ সালে ১০০টি কিল্লা নির্মাণ প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়া হয়। বাকি কিল্লাগুলোর কাজ সম্পন্ন করতে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়। এদিকে মুজিব কিল্লা নির্মাণ প্রকল্পে নানা অনিয়মের চিত্র দেখিয়েছে অডিট অধিদপ্তর। সংস্থাটির ২০২১-২২ অর্থবছরের অডিট প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ছাদের ত্রুটি সত্ত্বেও ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ, রক্ষা প্রাচীর (গাইডওয়াল) না করলেও বিল পরিশোধ, ৪২টি সাইটের ঠিকাদারকে অতিরিক্ত মাটির বিল দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সোলার প্যানেলের কাজ না করলেও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে বিল পরিশোধ, রডের পরিমাণ বেশি দেখিয়ে অতিরিক্ত বিল দেওয়া, পিসিসি ব্লক কম করার পরেও অর্থ ছাড়, কাজের পরিমাণ বেশি দেখিয়ে অর্থ লোপাট হয়েছে। শুধু অর্থ নিয়ে নয়, কাজের মান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন এর সুফল ভোগীরা। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রেজওয়ানুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, অডিট হলো একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া (কন্টিনিউয়াস প্রসেস), মুজিব কিল্লা নিয়ে অডিটের রিপোর্টের বিষয়ে আমরা অফিসিয়ালি ব্যবস্থা নেব। প্রকল্পের মেয়াদ আবারও বৃদ্ধি হবে কি না—এমন জিজ্ঞাসায় মহাপরিচালক বলেন, মুজিব কিল্লার প্রকল্প পরিচালক এবং প্ল্যানিং কমিশন যৌথভাবে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। তা ছাড়া একই ধরনের আরও প্রকল্প চলমান থাকলেও সরকার অনেক সময় ওই প্রকল্পের মেয়াদ আর বৃদ্ধি করে না। পরিকল্পনা কমিশনের অতিরিক্ত সচিব খন্দকার আহসান হোসেন বলেন, আমরা শুধু অর্থ বরাদ্দের বিষয়টি দেখি। কিন্তু মুজিব কিল্লা দেখভাল করার দায়িত্ব ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের। ফলে এটা তদারকি তারাই করবে। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার এ বিষয়ে বলেন, ‘এ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। যারা এই লুটপাটের সঙ্গে জড়িত, তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিচারের আওতায় আনা উচিত। বেশি লুটপাট করলে অবস্থা কি হয়, তা দেশবাসী এরই মধ্যে দেখতে পেয়েছেন।’