গত ১০ বছর আগে সরকারের সচিব পদে দায়িত্ব পালন করেছেন ৬৫ জন সচিব। বর্তমান সরকারের সিনিয়র সচিব ও সচিব হিসেবে কর্মরত মোট ৮১ জন। আবার সচিব মর্যাদায় গ্রেড-১ পদে ২৬ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। প্রশাসনে উচ্ছপদস্থ কর্মকর্তা সচিব পদের সংখ্যা কমানো পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে কিছু মন্ত্রণালয়কে একীভূত করে আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে। গতিশীল আনয়ন ও গুরুত্ব বিবেচনা করে জনস্বার্থে একত্রীকরণে এতে এক দিকে সরকারের ব্যয় কমবে অন্যদিকে প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোতে সুশাসন ও জবাদিহিতা নিশ্চিত হবে। ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ ও সুরক্ষা সেবা বিভাগ থেকে একীভূত করার অনুমোদন দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ দুই বিভাগকে একীভূত করতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সচিবকে নির্দেশনা দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। গতকাল রোববার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের পরিচালক এ কে এম মনিরুজ্জামান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সচিবকে পাঠানো হয়েছে। উপদেষ্টার কার্যালয়ের চিঠিতে বলা হয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুটি বিভাগ জননিরাপত্তা ও সুরক্ষা সেবা বিভাগ একত্রীকরণে বিভাগের কাজের ব্যাপকতা, অধিকতর সমন্বয়, গতিশীল আনয়ন ও গুরুত্ব বিবেচনা করে জনস্বার্থে একত্রীকরণে প্রধান উপদেষ্টা অনুশাসন দিয়েছেন। চিঠিতে আরো বলা হয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা ও সুরক্ষা সেবা বিভাগের একত্রীকরণের বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়ার অনুরোধ করা হলো। জানা গেছে, গত ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা আসার পরে সরকারি কর্মকর্তাদের দলীয় কাজের ব্যবহার করতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় দুই ভাগ করে সচিব পদ বৃদ্ধি সচিব পদে নিয়োগ করা হয়। এসব পদ বৃদ্ধি করে একদিকে সরকারের আর্থিক ক্ষতিকরা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব ও মন্ত্রিপরিষদ সচিবের জন্য বেতন সুপারিশ করা হয়েছে ৯০ হাজার টাকা (নির্ধারিত)। সিনিয়র সচিবের বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৪ হাজার টাকা (নির্ধারিত) এবং সচিবের বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে ৭৮ হাজার টাকা (নির্ধারিত)। বর্তমানে প্রতি বছর ২৩ হাজার কোটি ব্যয় হয় এ খাতে। এতে সরকারের এ খাতে ব্যয় বাড়ল দ্বিগুণেরও বেশি। যে কয়েকটি মন্ত্রণালয় দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে গত ১৬ বছরে প্রশাসনে জবাদিহিতা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে পারেনি। এসব মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সুবিধা বাড়লেও কর্মচারীদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। এতে কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ রয়েছে। দুই বিভাগ একত্র হলে অতিরিক্ত সহায়ক জনবলের প্রয়োজন হবে না বলে জানা গেছে। গত ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে কাজের সুবিধার যুক্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। এরপর থেকে সুযোগ-সুবিধা ও দায়িত্বকে কেন্দ্র করে জননিরাপত্তা বিভাগ ও সুরক্ষা সেবা বিভাগের কর্মরতদের মধ্যে মতানৈক্য তৈরি হয়। এ কারণে অন্তর্বর্তী সরকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আগের মতো একটি বিভাগে পরিণত করার পরিকল্পনা করছে। এতে আর্থিক ব্যয়ও অনেকটা কমে আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আবার এক বিভাগে রূপান্তর করতে জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ আবদুল মোমেনকে সুরক্ষা সেবা বিভাগেরও দায়িত্ব দেয়া হয়। মোহাম্মদ আবদুল মোমেন দায়িত্ব পাওয়ার পরে সুরক্ষা সেবা বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে মন্ত্রণালয়কে আগের মতো একটি বিভাগে রূপান্তরিত করার বিষয়ে আলোচনা হয়। সিনিয়র সচিব এ বিষয়ে মতামত দেয়ার জন্য বৈঠকে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা একটি গণমাধ্যমকে জানান। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানান, দুই বিভাগ একীভূত হলে কাজের সুবিধা হবে। এতে অভ্যন্তরীণ মনোমালিন্য দূর হবে এবং কাজের গতি বাড়বে। ২০১৭ সালের ১৯ জানুয়ারি জারি হওয়া এ বিষয়ক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পুনর্গঠন করে দুটি বিভাগ গঠন করেছেন। দুই বিভাগে দুজন সচিব থাকবেন। জননিরাপত্তা বিভাগের অধীনে রয়েছে পুলিশ, বিজিবি, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী, কোস্টগার্ড, তদন্ত সংস্থা ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আর সুরক্ষা সেবা বিভাগের অধীনে রয়েছে বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদফতর, কারা অধিদফতর, বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং ব্যবস্থা। বিদেশে পদায়নের সুযোগ পাওয়া না-পাওয়া এবং এক বিভাগের কর্মীদের পদায়নের দায়িত্ব অন্য বিভাগের হাতে থাকার মতো বিষয়ে দুই বিভাগের মধ্যে টানাপড়েন চলছে। বাইরে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পাসপোর্ট অফিস রয়েছে। এর আগে ২০১৪ সালে বিদেশে পাসপোর্ট ইস্যুর কাজটি পররাষ্ট্র থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনা হয়। এর তিন বছর পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দুই বিভাগে বিভক্ত করা হলে বিদেশে পাসপোর্ট অফিসে কাজ করার সুযোগ নিয়ে দুই বিভাগের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। পাসপোর্ট ইস্যুর কাজটি সুরক্ষা সেবা বিভাগ করে বলে এ বিভাগের কর্মীরাই বিদেশের পাসপোর্ট অফিসে কাজ করার সুযোগ পেয়ে আসছেন। একপর্যায়ে উভয় বিভাগের কর্মীদের সমান হারে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ দিতে পরিপত্র জারি করা হয়। বিষয়টি নিয়ে জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে উচ্চ আদালতে মামলা করা হয়। এ মামলায় জননিরাপত্তা বিভাগের পক্ষে রায় হয়। এর আলোকে উভয় বিভাগের মধ্যে সমহারে বিদেশে যাওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়। পরে সুরক্ষা সেবা বিভাগ এ নির্দেশনার বিরুদ্ধে আপিল করে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দুই ভাগে ভাগ হওয়ায় কর্মকর্তাদের সুবিধা হলেও কর্মচারীদের সমস্যা হয়। সহায়ক জনবলের ঘাটতি পূরণে মন্ত্রণালয়ে অন্তত ৪০-৪৫ জন পুলিশ সদস্যের পদায়ন হয়েছিল। তখ থেকে কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ রয়েছে। দুই বিভাগ একত্র হলে অতিরিক্ত সহায়ক জনবলের প্রয়োজন হবে না বলে মনে করছেন কর্মচারীরা। মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবার অধীনে থাকা পাসপোর্ট ফেরিভিকেশন ও ইমিগ্রেশনে পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন। অথচ পুলিশের পদায়নের দায়িত্বে রয়েছে জননিরাপত্তা বিভাগ। এটি উভয় বিভাগের মধ্যে অস্বস্তি ও অসন্তোষের অন্যতম কারণ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অর্গানোগ্রামে অতিরিক্ত সচিবের পদ রয়েছে। কিন্তু বিগত আওয়ামী লীগ সরকার প্রশাসনে ব্যাপকভাবে পদোন্নতি দেয়ায় বর্তমানে সেখানে অতিরিক্ত সচিবের পদ রয়েছে ১৫টি। এসব অতিরিক্ত সচিবের অধীনে সহায়ক জনবল দেয়ার জন্যই মূলত পুলিশ সদস্যদের পদায়ন করা হয়েছিল। বর্তমানে কোনো মন্ত্রণালয়ই অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী চলছে না। কাজের পরিধি বাড়ায় জনবলেরও প্রয়োজন বেড়েছে। তবে মন্ত্রণালয়ের সচিব একজন হলে অভ্যন্তরীণ সমস্যা থাকবে না। কাজের সুবিধার যুক্তিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কেও স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ এ দুই বিভাগে বিভক্ত করা হয়। কিন্তু বিভাগ ভাগ হলেও সেখানে ৮০ ভাগ ক্ষমতাই স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের হাতে রয়েছে। সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী ও অধ্যাপক পদে বদলি ও পদায়নের দায়িত্ব স্বাস্থ্যশিক্ষা বিভাগের ওপর ন্যস্ত হওয়ার কথা থাকলেও তা করে আসছে সেবা বিভাগ। এই নিয়ে বিভাগ দুটির মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে। সব কিছু মিলে অনেক সমস্যা দেখা দিয়েছে।