রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলেও চট্টগ্রাম খাদ্য বিভাগের বিতর্কিত ৫ হ্যান্ডলিং ঠিকাদার রয়েছেন বহাল তবিয়তে। সরকার নির্ধারিত মজুরি ফির বাইরে ‘বকশিশ’র নামে তারা পরিবহণ ঠিকাদারদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন টাকা। গত ৬ বছরে ৪৬৮ জন পরিবহণ ঠিকাদারের কাছ থেকে নিয়েছে ৫০-৬০ কোটি টাকা! তাদের কাছে জিম্মি হয়ে আছেন পরিবহণ ঠিকাদাররা। তাদের কথাই যেন আইন। তাদের কথার বাইরে কেউ কাজ পাওয়া তো দূরে থাক কথা বলারও সাধ্য নেই। খাদ্য বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তাদের প্রশ্রয়ে এসব ঠিকাদাররা এখনও বেপরোয়া। জানা গেছে, চট্টগ্রামের দুই সিএসডি (সেন্ট্রাল স্টোরেজ ডিপো), একটি সাইলো, চট্টগ্রাম জেলার ১৬টি এলএসডি (লোকাল স্টোরেজ ডিপো) ও কক্সবাজার জেলার ১০ এলএসডি (লোকাল স্টোরেজ ডিপো) ও খাগড়াছড়ি সদর এলএসডি হ্যান্ডলিং ঠিকাদার হিসাবে নিয়োজিত রয়েছে ৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানগুলো হলো-জয় কনস্ট্রাকশন, হাসান অ্যান্ড কোং, আসাদ ট্রেডিং, রাজ্জাক এন্টারপ্রাইজ ও তানজিলা এন্টারপ্রাইজ। সূত্র জানায়, এসব প্রতিষ্ঠান ২০০৯ সাল থেকে খাদ্য বিভাগে হ্যান্ডলিং ঠিকাদার হিসাবে নিয়োজিত রয়েছে। খাদ্য গুদামে সরকারি চাল, গম, খালি বস্তাসহ বিভিন্ন পণ্য লোড-আনলোড করে থাকে প্রতিষ্ঠানগুলো। দুই বছরের জন্য নিয়োগ পেলেও নানা কৌশলে তারা কঠিন শর্তের বেড়াজালে ফেলে নতুন কাউকে তালিকাভুক্তির সুযোগ দেয়নি। বিভাগের অসাধু কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে হ্যান্ডলিং ঠিকাদাররা খাদ্য বিভাগে জগদ্দল পাথর হয়ে চেপে বসে আছে। এসব ঠিকাদার সাইলো বা গুদাম থেকে পণ্য লোড আনলোড করে থাকে। পরিবহণ ঠিকাদাররা তা দেশের বিভিন্ন স্থানে বা গুদামে আনা-নেওয়া করে। পরিবহণ ঠিকাদারদের কাছ থেকে নানা অজুহাতে হ্যান্ডলিং ঠিকাদাররা বকশিশের নামা টাকা আদায় করে আসছে। এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দেওয়া হলেও জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। সূত্র জানায়, একজন পরিবহণ ঠিকাদার বছরে ৭০ থেকে ৮০ ট্রাক খাদ্যশস্য পরিবহণ করে থাকে। রুট ভেদে খাদ্যশস্য পরিবহণের বিপরীতে সরকার থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণে পরিবহণ বিল পেয়ে থাকে তারা। বিল সাবমিট করার কয়েক মাস পর নিয়ম অনুযায়ী সরকার বিলের বিপরীতে টাকা পরিশোধ করে। কিন্তু প্রতিদিন খাদ্যশস্য লোড-আনলোডের পর শ্রমিক বকশিশের নামে পরিবহণ ঠিকাদারদের কাছ থেকে ট্রাকপ্রতি নগদ ১ হাজার টাকা থেকে ২ হাজার ৭০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করে থাকে হ্যান্ডলিং ঠিকাদাররা। চট্টগ্রাম বিভাগে ৪৬৮ পরিবহণ ঠিকাদার রয়েছেন। প্রত্যেক ঠিকাদার প্রতি বছর ৮০ ট্রাক খাদ্যসশ্য পরিবহণ করেন। গত ৬ বছরে এসব ঠিকাদারের কাছ থেকে অন্তত ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকা বকশিশের নামে আদায় করা হয়েছে বলে পরিবহণ ঠিকাদাররা অভিযোগ করেছেন। বকশিশ না পেলে পরিবহণ ঠিকাদারদের নানাভাবে হয়রানি করা হয়। খাদ্য বিভাগের নথি ঘেঁটে দেখা যায়, ‘মেসার্স জয় কনস্ট্রাকশন’ নামে প্রতিষ্ঠানটি সবচেয়ে বেশি হ্যান্ডলিং ঠিকাদারি বাগিয়ে নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির মালিক সৈয়দ মাহমুদুল হক। তিনি কেন্দ্রীয় যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। তিনি রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে দেওয়ান হাট সিএসডির হ্যান্ডলিং ঠিকাদারি হাতিয়ে নেন। চট্টগ্রাম জেলার চারটি এলএসডি ও কক্সবাজার জেলার তিনটি এলএসডির হ্যান্ডলিংসহ ৭টি গুদামের হান্ডলিং ঠিকাদারিও রয়েছে তার প্রতিষ্ঠানের হাতে। একসঙ্গে এত গুদামের হ্যান্ডলিং ঠিকাদারি একজন ব্যক্তি বা একটি প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকাটা বিস্ময়কর। মেসার্স জয় কনস্ট্রাকশন চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী, কাটিরহাট, বোয়ালখালী ও সাতকানিয়া এলএসডির হ্যান্ডলিং ঠিকাদারি করছে। একইভাবে কক্সবাজার জেলার কক্সবাজার সদর, ঘোরকঘাটা ও কালারমার ছড়া (কেএম ছড়া) এলএসডির হ্যান্ডলিং ঠিকাদারিও প্রতিষ্ঠানটির দখলে। ‘মের্সাস হাসান অ্যান্ড কোং’ নামে অপর প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী মো. মাসুদ মাহমুদ। প্রতিষ্ঠানটির দখলে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া ও সন্দ্বীপ এলএসডির হ্যান্ডলিং ঠিকাদারি। একই প্রতিষ্ঠানটির দখলে রয়েছে কক্সবাজার জেলার চিরিঙ্গা, রামু ও টেকনাফ এলএসডির হ্যান্ডলিং ঠিকাদারি। দুই জেলার হ্যান্ডলিং বাগিয়ে নেওয়ার পর খাগড়াছড়ি সদর এলএসডির হ্যান্ডলিংও হাতিয়ে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। খাগড়াছড়ি সদর এলএসডির হ্যান্ডলিং ঠিকাদারি থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন খাগড়াছড়ি জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের হিসাবরক্ষক আজাদের রহমান। তিনি জানান, সদর এলএসডিতে হ্যান্ডলিং ঠিকাদার হিসাবে রয়েছে ‘মেসার্স হাসান কোং’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। মেসার্স তানজিলা এন্টারপ্রাইজ নামে প্রতিষ্ঠানটির দখলে রয়েছে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার চারটি এলএসডির হ্যান্ডলিং ঠিকাদারি। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী গোলাম রাব্বানি। চট্টগ্রামের দুটি এলএসডি হচ্ছে লোহাগাড়া ও চানপুরঘাট। কক্সবাজার জেলার দুটি এলএসডি হচ্ছে-বদরখালী ও ঝিলংজা। একইভাবে ‘মেসার্স আসাদ ট্রেডিং’ নামে প্রতিষ্ঠানটিরও চারটি এলএসডির হ্যান্ডলিং ঠিকাদারি রয়েছে। এসব এলএসডির মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামের হাবিলদার বাসা ও নাজির হাট। কক্সবাজার জেলার মধ্যে রামু ও উখিয়া এলএসডির হ্যান্ডলিং ঠিকাদারি রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী আসাদুজ্জামান মজুমদার। মেসার্স রাজ্জাক এন্টারপ্রাইজ নামে অপর একটি প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে হালিশহর সিএসডির হ্যান্ডলিং ঠিকাদারি দখলে রেখেছে। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী আবদুর রাজ্জাক। রাজ্জাক এন্টারপ্রাইজের কবজায় সীতাকুণ্ড এলএসডি ও কক্সবাজারের বড়ঘোপ এলএসডিও রয়েছে। তিনি বাঁশখালী উপজেলার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। একইভাবে চট্টগ্রাম সাইলোর হ্যান্ডলিং ঠিকাদারি পরিচালনা করছে ‘মেসার্স সোনালী এন্টারপ্রাইজ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। বকশিশের নামে চাঁদাবাজির বিষয়টি নিয়ে ২ মে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কাছে লিখিত অভিযোগ দেয় বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় খাদ্য পরিবহণ অ্যাসোসিয়েশন। এছাড়া অন্য যেসব অঞ্চলে এভাবে বাড়তি টাকা নেওয়া হচ্ছে, সেসব অঞ্চলের খাদ্য নিয়ন্ত্রকের দপ্তরেও অভিন্ন চিঠি দিয়ে চাঁদাবাজি বন্ধের দাবি জানানো হয়। তারপরও বন্ধ হয়নি অবৈধভাবে টাকা নেওয়া। খাদ্য নিয়ন্ত্রণ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামের হালিশহর ও দেওয়ানহাট সিএসডি, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন এলএসডিতে বকশিশের নামে বাড়তি টাকা আদায় করা হচ্ছে। এ নিয়ে পরিবহণ ঠিকাদারদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। পরিবহণ ঠিকাদার ‘মেসার্স রশিদ এন্টারপ্রাইজের’ মালিক জাকির হোসেন বলেন, চক্রটি দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় ধরে হ্যান্ডলিং ঠিকাদারির নামে লুটপাট করছে। প্রতি টনে ১২০ থেকে ১৪৪ টাকা হারে সরকারের কাছ থেকে কমিশন পেয়ে থাকেন হ্যান্ডলিং ঠিকাদাররা। এরপরও পরিবহণে নিয়োজিত ঠিকাদারের কাছ থেকে ট্রাকপ্রতি ৯০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা করে বাড়তি আদায় করেন। এটাকে তারা ‘বকশিশ’ বললেও প্রকৃত অর্থে চাঁদাবাজি। অভিযোগের বিষয়ে হালিশহর সিএসডির হ্যান্ডলিং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স রাজ্জাক এন্টারপ্রাইজের মালিক আবদুল রাজ্জাক বলেন, বকশিশের নামে বাড়তি টাকা নেওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। অবৈধভাবে টাকা আদায়ের ব্যাপারে আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক বরাবর বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় খাদ্য পরিবহণ অ্যাসোসিয়েশনের দেওয়া চিঠির বিষয়টিও তিনি অস্বীকার করেন।