বরগুনা-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাড. ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুকে গ্রেফতারের খবরে তার নির্বাচনী এলাকা বরগুনা- আমতলী-তালতলীতে আনন্দের বন্যা বইছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার দলের নেতাকর্মীরাও দ্রুত তার শাস্তির পাশাপাশি তার অর্জিত অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে বরগুনার উন্নয়নে ব্যয় করার দাবী করেছেন। বরগুনা-১ আসনের পাঁচবারের সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাড. ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু তার রাজনৈতিক জীবনে গড়ে তুলেছেন অপরাজনীতির সংস্কৃতি। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের উপেক্ষা করে হাইব্রীড আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের দিয়ে দল পরিচালনা করেছেন। গড়ে তুলেছেন অপরাধের অভয়ারন্য। ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ, দখল জবরদখল, মাদকের পৃষ্ঠপোষকতা, সন্ত্রাস, ইসলাম বিদ্বেষী বক্তব্য প্রদান, কাবিখা টাবিখা, সরকারি বেসরকারি ত্রাণ সামগ্রী লুটপাট, মতবিরোধীদের দমনপীড়ন, দলীয় পদ বানিজ্য, মনোনয়ন বানিজ্য, বদলি বাণিজ্য, নিজ এলাকার স্বার্থ উপেক্ষাসহ নানাবিধ অপকর্ম করে বেড়াতেন নির্বিঘ্নে। দীর্ঘ তিন যুগ জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি, ২৫ বছর বরগুনা-১ আসনের সংসদ সদস্য থাকায় তোয়াক্কা করেননি কাউকেই। তার প্রতি ভারত সরকারের একনিষ্ঠ সমর্থন থাকায় ক্ষমতার দাম্ভিকতা ছিল আকাশচুম্বী। ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বরগুনা সদর উপজেলায় ভায়রা সিদ্দিক (ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছোট শ্যালিকার স্বামী), আলতাফ মাওলানা, কথিত মুক্তিযোদ্ধা কালা রশিদসহ বেশকিছু সুবিধাভোগীর মাধ্যমে বিভিন্নভাবে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। ভায়রা সিদ্দিককে ক্ষমতার অপব্যবহার করে সদরের বুড়িরচর ইউনিয়নের দুই দুইবার চেয়ারম্যানও বানিয়েছিলেন। ভায়রা সিদ্দিক ঠিকাদারীর নামে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছেন। তিনি বুড়িরচর ইউনিয়নের উচ্চ শিক্ষিত এক যুবনেতাকে হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে চার্জশিটভুক্ত আসামি। জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক মাওলানা আলতাফ হোসেন অ্যাডভোকেট ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এলাকায় তাকে আলতাফ দেবনাথ হিসেবেই মানুষ চিনে। একসময়ের ভূমিহীন এখন হাজার কোটি টাকার মালিক। পিআইও রনজিত কাবিখা-টাবিখাসহ বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থ ও সরকারি ত্রাণ সামগ্রী লুটপাটের কারিগর। সিংহভাগ এমপি শম্ভুকে দিয়ে বাকি অর্থ তিনি লুটেপুটে খেতেন। ঠিকাদারী পার্টটা দেখতেন আবুল নামের এক ঠিকাদার। আবুল হোসেনও আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ। সাবেক এমপি শম্ভুকে অবৈধ সুবিধা দেয়া-নেয়ার তালিকা অনেক লম্বা বিধায় উল্লেখ করা গেল না। প্রথম এমপি নির্বাচিত হওয়ার পূর্বে রাজনীতির পাশাপাশি বরগুনায় ওকালতি করতেন। বরগুনা পৌর এলাকার আমতলা সড়কে ভাঙাচোরা চৌচলা একটা টিনশেড ঘরে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করতেন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু। তৃতীয়বার এমপি হয়েই অনৈতিকতার পথে দ্রুত হাঁটতে থাকেন। জানা গেছে, রাজধানীর গুলশানে ৩ হাজার ৩০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে শম্ভুর। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা এবং প্রিয়প্রাঙ্গণে রয়েছে স্ত্রী-কন্যাসহ পরিবারের সদস্যদের নামে ৪টি প্লট। ১ হাজার ৩শ\' বর্গফুট আয়তনের ২টি ফ্ল্যাট রয়েছে মধ্য বাড্ডায়। নিজেরসহ স্ত্রী, পুত্র, কন্যাদের নামে রয়েছে ৪টি বিলাসবহুল গাড়ি। বরগুনা মহাসড়ক এলাকায় এক একরেরও বেশি জমি কিনেছেন ছেলে সুনাম দেবনাথ। বরগুনার তালতলী উপজেলার বড় নিশানবাড়িয়ায় রয়েছে ১৭.৫২ একর জমি। রাখাইনদের সঙ্গে প্রতারণা করে ওই জমির মালিক হয়েছেন শম্ভু। গাজীপুরে রয়েছে নিজস্ব জমিতে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি। আমতলী পৌরসভা এলাকায়ও জমি রয়েছে তার। ভারতের রয়েছে তার বিশাল বাড়ি। বাড়ি নির্মাণের জন্য বরগুনা থেকে পাসপোর্ট ভিসা করিয়ে ভারতে শ্রমিক নিয়েছিলেন শম্ভু। শোনা যাচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও তার বাড়ি ও সম্পত্তি রয়েছে। বরগুনা সদর উপজেলা পরিষদের সামনের পুকুরের সিংহভাগ দখল ও ভরাট করে বাড়ি দৃষ্টিনন্দন বাড়ি বানিয়েছেন শম্ভু। বাড়িটি করতে কয়েক কোটি টাকা খরচ করেছেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে, বিশাল আয়তনের ওই জমির একাংশের মালিক দাবিদার সুন্দরী কাপালী এবং নারায়ণ চন্দ্র সিংহের বর্তমান প্রজন্ম। জানা যায়, শম্ভুর গড়া ওই বাড়ির মধ্যে একসময় মদনমোহন জিউর মন্দির ছিল। এসএ ৮০৩ খতিয়ানে ২৪৯নং দাগে ওই মন্দিরের নামে রয়েছে ৮২ শতাংশ জমি। সেই জমিও দখল করে নিয়েছেন তিনি। শম্ভু এমপি থাকা অবস্থায় সংবাদ সম্মেলন করে বরগুনার আওয়ামী লীগ নেতারা বলেছেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পিওন-নৈশপ্রহরী নিয়োগে পর্যন্ত ঘুষ দিতে হতো তাকে। টাকা ছাড়া কোনো কাজ করেন না শম্ভু। টিআর, কাবিখা, কাবিটা আর ৪০ দিনের কর্মসূচির নামে কোটি কোটি টাকার ভাগবাঁটোয়ারা হয় সংসদ-সদস্য ও তার লোকজনের মধ্যে। সংসদ-সদস্য থাকাকালে শম্ভুর বিরুদ্ধে একবার ঘুস, দুর্নীতি, সন্ত্রাসসহ ২৪টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উল্লেখ করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবিরসহ অন্যান্য নেতারা। সে সময় তাকে বরগুনায় অবাঞ্ছিতও ঘোষণা করেছিলেন আওয়ামী লীগ নেতারা। ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর একমাত্র ছেলে সুনাম দেবনাথের বিরুদ্ধে ছিল মাদক ব্যবসার সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ। চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের পর বরগুনা ছিল মাদক চোরাচালানের অন্যতম একটি কেন্দ্র। সাগর পারের বরগুনা থেকে মাদকের চালান যেত দেশের বিভিন্ন স্থানে। পুরো বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করতেন সুনাম। জেলা পুলিশের দেয়া গোপন প্রতিবেদনেও মাদক বাণিজ্যের হোতা হিসাবে নাম ছিল সুনামের। সুনামের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করে মাদক বাণিজ্যে যুক্ত থাকার অভিযোগ এনেছিলেন তৎকালীন জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি জুবায়ের আদনান অনীক। আমতলী উপজেলায় এক সময়ের বিএনপি নেতা সাবেক পৌর মেয়র মতিয়ার রহমান খলিফা ও তার ভাই সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মজিবুর রহমানকে দলে এনে আমতলীতে গড়ে তুলেছেন অপরাজনীতির সংস্কৃতি। তাদের মাধ্যমে তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের শোষন ও মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানী করেছেন এমন অভিযোগ তৃণমুল নেতাকর্মীদের। ত্যাগী নেতাকর্মীরে দলের মধ্যে জায়গা দেয়নি শম্ভু। কাগজে কলমে প্রকল্প দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। তালতলী উপজেলায় সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান মিন্টু, রেজবি-উল কবির জোমাদ্দার, উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক, ছোটবগী ইউপি চেয়ারম্যান মুহাম্মদ তৌফিকুজ্জামান তনু, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা জাকির হোসেন চুন্নু মাষ্টারসহ বেশ কয়েকজন নেতার মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। শেখ হাসিনার উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে ব্যহত করেছেন শম্ভু। পাঁচবার সাংসদ থাকাকালিন অবস্থায় কয়েক’শ কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে ঢাকাসহ ভারত, আমেরিকা ও সিঙ্গাপুরে গড়ে তুলেছেন অট্টালিকা এমন দাবী দলীয় নেতাকর্মীদের। গত ১৫ বছরে তিনি বরগুনা-আমতলী-তালতলীর মানুষকে শোষন ও নির্যাতন করেছেন। দলের মধ্যে কোন্দল সৃষ্টি করে নেতাকর্মীদের বিভক্ত করে রেখেছেন। তার পছন্দের নেতাকর্মী দিয়ে দল পরিচালনা করেছেন। গত ১৫ বছরে শম্ভু ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের দুঃশাসনে দলীয় নেতাকর্মী ও প্রত্যান্ত অঞ্চলের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেছে এমন দাবী তৃণমুল কর্মী আফজাল হোসেনের। ওই সময়ে আমতলী উপজেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি সাবেক পৌর মেয়র মতিয়ার রহমান, পৌর আওয়ামীলীগ সভাপতি সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মোঃ মজিবুর রহমান, চাওড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামান বাদল খাঁনসহ গুটি কয়েক নেতা আমতলীতে অপরাধের সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। তাদের ইশারা ছাড়া আমতলীর একটি পাতাও নড়তে পারেনি। জমি দখল, নিয়োগ বানিজ্য, টেন্ডার বানিজ্য, মাদক বানিজ্য, চাঁদাবাজি, কিশোর গ্যাং লালন পালনসহ সকল অপরাধই ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণে। কিশোর গ্যাং লিডার ইসফাক আহম্মেদ তোহা ও সবুজ ম্যালাকারসহ তাদের সাঙ্গপাঙ্গ দিয়ে দলের সিনিয়র নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষদের মারধর করাতো। উপজেলার নেতারা সকল বানিজ্যের টাকার সিংহভাগ পৌছে দিতেন সংসদ সদস্য শম্ভুর নিকট। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারী অনুষ্ঠিত একদলীয় নির্বাচনে নৌকা মার্কা পেয়েও শম্ভু স্বতন্ত্র প্রার্থী গোলাম সরোয়ার টুকুর কাছে হেরে যান। গত ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে গেলে শম্ভু আত্মগোপনে চলে যান। গত তিন মাস নিরুদ্দেশ থাকার পর গত সোমবার রাতে ঢাকার উত্তরা ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। তার গ্রেফতারের খবর বরগুনা-আমতলী-তালতলীতে ছড়িয়ে পড়লে দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার গ্রেফতারের খবরে নেতাকর্মীরা উচ্ছাসিত। দ্রুত তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির পাশাপাশি শম্ভুর অর্জিত অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে বরগুনার উন্নয়নে ব্যয় করার দাবী করেছেন এলাকাবাসী।