দ্বীপের সুরক্ষা বাঁধই অরক্ষিত, দুর্যোগে জানমালের ঝুঁকি

প্রকাশিতঃ নভেম্বর ১৬, ২০২৪ | ৯:১২ পূর্বাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

শুক্রবার পূর্ণ হয়েছে ভয়াল ঘূর্ণিঝড় সিডরের ১৭ বছর। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে ভয়ানক এই ঘূর্ণিঝড়। কিন্তু এর বছরের পর বছর গেলেও অরক্ষিত রয়েছে সাগর ও নদী বেষ্টিত দ্বীপ ‘রাঙ্গাবালী’। সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, দুর্যোগপ্রবণ এ জনপদের দুর্গম এলাকা চরনজির, চরকাশেম ও চরহেয়ারÑএ এখনও বেড়িবাঁধ নির্মাণ হয়নি। ফলে দুর্যোগকালীন নদীতে জোয়ারের পানি বাড়লে সেখানকার মানুষের জীবনের ঝুঁকিও বেড়ে যায়। শুধু এই তিন চর নয়-যেখানে বাঁধ আছে, সেখানকার মানুষেরও ঝুঁকি রয়েছে। কারণ- উপকূলের মানুষের জানমাল সুরক্ষায় নির্মিত বাঁধগুলোর দশা অনেকটাই বেহাল। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য বলছে, ১৯৮৭ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে ধাপে ধাপে উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে ১৮৭ দশমিক ৯৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এ বাঁধগুলোর উচ্চতা ছিল ৪ দশমিক ৩ থেকে সর্বোচ্চ ৬ মিটার পর্যন্ত। বহু বছর আগে নির্মিত এ বাঁধগুলোর অবস্থা এখন নাজুক। উপজেলার চরমোন্তাজ ইউনিয়নের নয়ারচর, বউবাজার, চরআন্ডা, চালিতাবুনিয়া ইউনিয়নের মধ্য চালিতাবুনিয়া, বিবির হাওলা, চরলতা, ছোটবাইশদিয়া ইউনিয়নের কোড়ালিয়া, চরইমারশন, কাউখালী, মৌডুবি ইউনিয়নের কাজিকান্দাসহ বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, কোথাও কোথাও বাঁধের উচ্চতা আছে এখন মাত্র দুই থেকে তিন মিটার। কোথাও বাঁধ ভেঙে আছে। কোথাও আছে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। যেকোন মুহুর্তে ভেঙে যাওয়ার উপক্রম। আরও দেখা গেছে, নতুন করে যেসব বাঁধ সংস্কার হয়েছে- সেগুলোও টেকসই নয়। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সেগুলোও ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার শঙ্কা স্থানীয় মানুষের। আগুনমুখা ও ডিগ্রি নদী ঘেঁষা চালিতাবুনিয়া ইউনিয়নের দুই নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা নেছার হাওলাদার বলেন, ‘নদী ভাঙন কবলিত এলাকার মানুষ আমরা। প্রতিবার বাঁধ ভেঙে বিলীন হয় বসতভিটা। এ পর্যন্ত দুইবার বাড়ির জায়গা বদলেছি। এরপর বাঁধ ভাঙলে পরিবার-পরিজন নিয়ে কোথায় যাবো সেটাই চিন্তা করতেছি। টেকসই এবং উঁচু করে ব্লক বাঁধ নির্মাণ করলে আমাদের বাঁধ ভাঙার আর কোন ঝুঁকি থাকতো না।’ ছোটবাইশদিয়া ইউনিয়নের চরইমারশন গ্রামের হেলাল খান বলেন, ‘ঝড়-বন্যা আমাদের নিত্যদিনের সাথী। সিডর, আইলা, মহাসেনসহ বিভিন্ন ঘূর্ণিঝড়ে আমাদের ক্ষয়ক্ষতি হয়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় বাঁধ ভেঙে, বাঁধ উপচে পানি ঢুকে। পুকুর-ঘেরের মাছ ভেসে যায়। ফসল নষ্ট হয়। ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়।’ একই ইউনিয়নের কোড়ালিয়া গ্রামের বজলুর রহমান হাওলাদার বলেন, ‘আমাদের গ্রামের এই বাঁধের উচ্চতা অনেক কম। কোথাও কোথাও মাত্র দুই-তিন মিটার। জোয়ারের পানি বাঁড়লেই বাঁধ ছুইছুই অবস্থা। আর ঝড়-বন্যা হলে পানি ঢুকে যায়। সহায়-সম্পদের ক্ষতি হয়। তাই বাঁধগুলো উঁচু করা খুবই প্রয়োজন।’ জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পটুয়াখালী নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফ হোসেন বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাস যখন হয়, তখন স্বাভাবিকের চেয়ে পানির উচ্চতা বেশি থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন পানির উচ্চতা দুর্যোগকালীন সময়ে আরও বেশি হয়। যে কারণে জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে। আমাদের আগের বেড়িবাঁধের উচ্চতা ছিল ৪ দশমিক ৩ মিটার থেকে ৬ মিটার পর্যন্ত। উপকূলীয় বেড়িবাঁধ উন্নয়ন প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপে রাঙ্গাবালীসহ বিভিন্ন উপজেলায় ৭ থেকে সাড়ে ৭ মিটার উচ্চতার বেড়িবাঁধ করার পরিকল্পনা রয়েছে। সেই প্রকল্প এখনও প্লানিং পর্যায়ে রয়েছে। প্রকল্পের ইনসেফশন রিপোর্ট তৈরি হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বিশ্ব ব্যাংকের মাধ্যমে কাজটি যাতে বাস্তবায়ন করতে পারি, সে লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে আলাপ চলছে। এটি এখনও অনুমোদিত হয়নি। প্রকল্প অনুমোদিত হলে বিশ্ব ব্যাংক কিংবা অন্য কোন উন্নয়ন সংস্থা বাজেট দেওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলে পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রকল্প বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।’ যেসব চরে এখনও বেড়িবাঁধ নির্মাণ হয়নি, সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের সব জায়গায় বেড়িবাঁধ করা সম্ভব না। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিতে হয়। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হয় কিনা সেই সম্ভাবতা যাচাইয়ের বিষয় আছে। পরিবেশ ও মানুষের উপকার হয়, এমন স্থানে বেড়িবাঁধ করা হয়। সাগর ও নদী ঘেরা রাঙ্গাবালীর বাঁধগুলো স্থায়ী সুরক্ষা দেওয়ার জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা লাগবে। এসব বিষয় বিবেচনা করে এতদিন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কিন্তু এখন আমরা যেখানে জনসংখ্যা বেশি এই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় সেসব এলাকার বাঁধগুলো স্থায়ী সুরক্ষার পরিকল্পনা করেছি।’ এ ব্যাপারে জলবায়ু গবেষক ও শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান অনুষদের বিভাগীয় চেয়ারম্যান ড. মো. শাহরিয়ার জামান বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের যত ক্ষতিকর দিক রয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া। সেই সঙ্গে প্রচণ্ড খরা হওয়া, অসময়ে অতিরিক্ত বৃষ্টি হওয়া, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাওয়। আমরা ৭০’ পরবর্তী অনেক ঘূর্ণিঝড় দেখেছি। এরমধ্যে শুধু সিডরেই ১০ লক্ষ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করে। আমরা একটি গবেষণায় দেখেছি শুধু বাংলাদেশে ০.৩ মিটার সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার কারণে ০.৫ মিলিয়ন মেট্রিকটণ ধানের উৎপাদন কমে গেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘উপকূলীয় এলাকার জীবন রক্ষা বাঁধগুলো সেই ৭০ দশকের পরবর্তী নির্মাণ করা হয়েছে। সেসব প্রাকৃতিকসহ নানা কারণে ক্ষতিগ্রস্ত। যথাযথভাবে মেরামতও করা হয় না। একারণে বিভিন্ন ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাসে লবণাক্ত পানি খুব সহজেই উপকূলীয় এলাকায় প্রবেশ করে কৃষি উৎপাদনকে ব্যাহত করে। কাজেই এই বাঁধগুলো নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্লকসহ যথাযথ প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে। টেকসই এবং উঁচু বাঁধ নির্মাণ করতে হবে।’