ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) দক্ষিণ বারিধারা আবাসিক এলাকার ৬ নম্বর সড়কের কিছু অংশ এখনো কাঁচা। কয়েক বছর ধরে স্থানীয় বাড়ির মালিকরা নিজস্ব অর্থায়নে পাকা সড়ক নির্মাণ করেছেন। আট বছর আগে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত হলেও উন্নয়নের কোনো ছোঁয়া লাগেনি। বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় প্রতি বর্ষায় কোমরসমান পানিতে জলাবদ্ধতায় ভুগতে হয় স্থানীয়দের। তাদের দীর্ঘদিনের দাবির মুখে সম্প্রতি ওই এলাকায় সড়ক ও ড্রেন নির্মাণের কাজ শুরু করেছে ডিএনসিসি। তবে কাজ শুরুর আগেই ঘুষ দাবির অভিযোগ উঠেছে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে। স্থানীয়রা বলছেন, এই আবাসিক এলাকার ৪, ৫, ৭, ৮ ও ৯ নম্বর সড়কের কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু ৬ নম্বর সড়কের নিচু এলাকায় কাজ হচ্ছে না। সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের ঘুষ না দেওয়ায় তাদের উন্নয়নবঞ্চিত করা হচ্ছে। ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে সড়ক ও ড্রেন নির্মাণে ঠিকাদার-প্রকৌশলী মিলে লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। এদিকে ডিএনসিসি বলছে, পর্যাপ্ত বাজেট না থাকায় সব সড়কে আশানুরূপ কাজ হচ্ছে না। ডিএনসিসি সূত্রে জানা গেছে, ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ বারিধারা আবাসিক এলাকার ১ দশমিক ২৬৬ শতাংশ কিলোমিটারজুড়ে ছয়টি সড়ক ও ড্রেন নির্মাণের কাজ গত ২২ জুলাই শুরু হয়েছে। দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইফাত এন্টারপ্রাইজ কাজটি করছে। ৭ কোটি টাকার এই উন্নয়নকাজ আগামী বছরের ২১ জুলাইয়ের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। ৪ নম্বর সড়কের হোল্ডিং নম্বর ৪৪ থেকে গোবিন্দ মন্দির পর্যন্ত এবং তৎসংলগ্ন সংযোগ সড়ক হোল্ডিং নম্বর ৭১ থেকে রোড নম্বর ৮ পর্যন্ত আরসিসি পাইপের নর্দমা স্থাপনসহ সড়ক উন্নয়ন কাজ হবে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ছয়টি সড়কে উন্নয়ন কাজের সীমানা নির্ধারণে ডিএনসিসির প্রকৌশলীরা মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ নিয়েছেন। ঘুষ না দেওয়ায় কয়েকটি সড়কে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নকাজ হচ্ছে না। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এই কাজের ঠিকাদার ইমান আলী পলাতক রয়েছেন। চুক্তিভিত্তিক ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছেন আরেকজন। ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজশ করে লুটপাটে নেমেছেন উন্নয়নকাজের মান তদারকিতে থাকা প্রকৌশলীরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৬ সালে ডিএনসিসির নতুন ১৮টি ওয়ার্ডের আওতাভুক্ত হয় আটটি ইউনিয়ন। সিটি করপোরেশনের মর্যাদা পাওয়ার পর আট বছর পার হলেও নতুন ওয়ার্ডগুলোতে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। অধিকাংশ সড়ক ভাঙাচোরা। সামান্য বৃষ্টিতেই জমে হাঁটুপানি। ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় প্রতি বছরই জলাবদ্ধতায় ভুগতে হয় এলাকাবাসীকে। নেই স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র ও কমিনিউনিটি সেন্টারের মতো নাগরিক সুযোগ-সুবিধা। খোদ রাজধানীর ভেতরে উন্নয়ন না হওয়া নিয়ে অসন্তোষ ও ক্ষোভ রয়েছে স্থানীয়দের মধ্যে। গত বুধবার ওই এলাকা ঘুরে দেখা যায়, দক্ষিণ বারিধারা আবাসিক এলাকার ১৭টি সড়কের মধ্যে বেশিরভাগই মাটির রাস্তা। এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা দিয়ে যানবাহন চলাচলে ভোগান্তির শেষ নেই। গাড়ির চাকা আটকে যায় গর্তে। ৫ নম্বর সড়কের বাসিন্দা হাফিজুর রহমান বলেন, সড়কগুলো খুবই নিচু ও ভাঙাচোরা, বর্ষাকালে এ সড়কে হাঁটার কোনো উপায় থাকে না। রাস্তা কোমরসমান ময়লা পানিতে ডুবে যায়। পানি কমলেও দীর্ঘদিন ধরে কাদা সরে না। ওই এলাকায় বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। সড়কের দুরবস্থার কারণে শিক্ষার্থীদের কষ্টে চলাচল করতে হয়। ৮ নম্বর সড়কের বাড়ির মালিক আফরোজা ইয়াসমিন বলেন, নামেই সিটি করপোরেশনের সঙ্গে যুক্ত। গত আট বছরে দৃশ্যত উন্নয়ন হয়নি। সিটি করপোরেশনের বাসিন্দা হিসেবে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। ২০১৬ সাল থেকে বাড়ির মালিকরা টাকা দিয়ে এলাকায় সড়ক নির্মাণ ও সংস্কার করেছেন। সেবা দিতে না পারলেও হোল্ডিং ট্যাক্স আদায়ে বাসায় লোক পাঠিয়ে চাপ দেওয়া হয়। আমরা যেহেতু নাগরিক সুবিধা পাচ্ছি না, তাহলে কেন আমরা এই ট্যাক্স দেব? এদিকে দুই মাস আগে উন্নয়ন কাজ শুরু হলেও তা চলছে ধীরগতিতে। স্থানীয় লোকজন বলছেন, সাতদিন আগে পুরোদমে কাজ শুরু হয়েছে। নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে দায়সারা কাজ চলছে। সিটি করপোরেশনের লোকজন কাজ তদারকিতে আসেন না। ঠিকাদারের লোকজন ইচ্ছামতো পুকুরচুরি করছে। দেখার কেউ নেই। ৬ নম্বর সড়কের একাধিক বাড়ির মালিক অভিযোগ করেন, সিটি করপোরেশনের প্রকৌশলীদের ঘুষ না দেওয়ায় আমাদের উন্নয়নবঞ্চিত থাকতে হচ্ছে। একই অবস্থা ৫, ৮ ও ৯ নম্বর সড়কের বাসিন্দাদের। সেখানেও আংশিক উন্নয়নকাজ হচ্ছে। এসব সড়কের বাড়ি মালিকরা বলেন, বর্ষায় কাদা ও পানির কারণে বাড়ি থেকে বের হওয়ার অবস্থা থাকে না। মূল ঠিকাদার ইমান আলীর কাছ থেকে চুক্তি নিয়ে এই উন্নয়নকাজ করছেন আরেক ঠিকাদার বিল্লাল মুন্সী। তিনি বলেন, আমি সাব-ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছি। চার নম্বর সড়কের কাজ শিগগিরই শেষ হবে। এরপর সাত নম্বর সড়কের কাজ শেষে অন্য সড়কগুলোর কাজ হবে। ৭ নম্বর সড়কেই আলিশান বাড়ি ঠিকাদার ইমান আলীর। বাড়ির নিচতলায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়। জানতে চাইলে সেখানকার এক কর্মচারী বলেন, স্যার এলাকায় নেই। বাইরে আছেন। তবে ডিএনসিসির হিসাবে সব ঠিকমতো চলছে। অঞ্চল-১০-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মতিউর রহমান বলেন, এলাকাটি আগে ইউনিয়ন পরিষদে ছিল। সিটি করপোরেশনের নতুন এলাকা হলেও বেশিরভাগ সড়ক ভাঙাচোরা। যেসব সড়কের অবস্থা বেশি খারাপ, সেগুলোর কাজ আগে হচ্ছে। মূলত এসব এলাকায় যেন পানি না ওঠে, সেজন্য পাইপলাইন করছি। গত সপ্তাহেও পরিদর্শন করেছি। ৬ নম্বর সড়কে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকলেও সেখানে কেন কাজ হচ্ছে না জানতে চাইলে এই প্রকৌশলী বলেন, ৬ নম্বর সড়ক বাজেটেই ছিল না। বরাদ্দের সীমাবদ্ধতার কারণে সব সড়কের কাজ করা যাচ্ছে না। ওই এলাকায় উন্নয়নকাজের সীমানা নির্ধারণ নিয়ে ঘুষ গ্রহণের বিষয়ে তিনি বলেন, কে বা কারা ঘুষ নিয়েছে তা আমার জানা নেই। জানতে চাইলে ডিএনসিসির প্রধান প্রকৌশলী ব্রিগে. জেনা. মো. মঈন উদ্দিন বলেন, সড়ক ও ড্রেন নির্মাণে অনিয়মের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।