প্রথমবারের মতো দেশের পার্বত্য অঞ্চলে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের উদ্যোগ নিয়েছে পেট্রোবাংলা। পার্বত্য অঞ্চলের গ্যাস ব্লক ২২বি-তে প্রথম অনুসন্ধান কাজ চালানো হবে। এরই মধ্যে ১৯৯৭ সালের উৎপাদন বণ্টন চুক্তি (প্রোডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট—পিএসসি) সংশোধন করে খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। খসড়া পিএসসি চূড়ান্ত করতে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হবে। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার এ প্রসঙ্গে বলেন, সরকার আশা করছে, আগামী ফেব্রুয়ারির (২০২৫) মধ্যে পিএসসি চূড়ান্ত করে মার্চে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা যাবে। পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশীয় গ্যাস উৎপাদনের শতভাগ আসে স্থলভাগের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে। কিন্তু কখনো পার্বত্য অঞ্চলে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কার্যক্রম চালানো হয়নি। এবারই প্রথমবারের মতো পার্বত্য অঞ্চলে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কার্যক্রম শুরু করা হবে। এজন্য পার্বত্য অঞ্চলের ব্লক ২২বি-তে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ধারণাগতভাবে এই ব্লকে তেল-গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ব্লক ২২বি-তে পার্বত্য অঞ্চলে রয়েছে বান্দরবান, থানচি, রুমা, আলীকদম, চকরিয়া, আনোয়ারা, কাপ্তাই এলাকা। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, ১৯৯৭ সালের পর স্থলভাগের পিএসসি হালনাগাদ করা হয়নি। সম্প্রতি তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে জোর দেওয়ার পর ২৭ বছর পর স্থলভাগের পিএসসি হালনাগাদ করে এরই মধ্যে খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। খসড়ায় স্থলভাগে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে আকৃষ্ট করতে বেশ কিছু সংশোধন আনা হয়েছে। দেশে গত এক দশকে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত গ্যাসের উত্তোলন দিন দিন কমছে। দেশে গ্যাসের চাহিদা মেটাতে এই সময় আমদানির ওপর নির্ভরতা বেড়েছে। বড় বড় গ্যাসক্ষেত্রের মজুত ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে। এ অবস্থায় স্থালভাগে গ্যাস অনুসন্ধানের ওপর জোর দেয়ার পাশাপাশি পরিত্যক্ত গ্যাসকূপগুলোকে ফের খনন ও সংস্কারের মাধ্যমে গ্যাস উত্তোলনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ শুরু করেছে পেট্রোবাংলা। বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্রের ৯৮টি কূপ সাময়িক বন্ধ ও পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে ৬৭টি সংস্কারের মাধ্যমে উৎপাদনে আনা সম্ভব। বাকিগুলোতেও কাজ করার সুযোগ আছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তার চেয়ে কম সময়ে স্থলভাগের অনুসন্ধান-কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব। দ্বিমাত্রিক জরিপের ভিত্তিতে উচ্চ সম্ভাবনাময়, মাঝারি সম্ভাবনাময় ও ন্যূনতম সম্ভাবনাময় এই তিন ক্যাটাগরিতে ব্লকগুলোকে ভাগ করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক দরপত্রে দেশীয় অনুসন্ধান কোম্পানিগুলোকে অংশ নেওয়ার সুযোগ রাখা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর টেকনিক্যাল, ফিন্যান্সিয়াল ও দক্ষ মানবসম্পদের ওপর ভিত্তি করে কাজ পাওয়ার সুযোগ রাখা হচ্ছে। বর্তমানে দেশে তিনটি রাষ্ট্রীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি হলো বাপেক্স, বাংলাদেশ গ্যাসফিল্ড কোম্পানি এবং সিলেট গ্যাসফিল্ড কোম্পানি। ওই কর্মকর্তা আরও জানান, স্থলভাগে মোট ২২টি ব্লক রয়েছে। এর মধ্যে ১১টিতে এখনো কোনো ধরনের অনুসন্ধান কার্যক্রম চালানো হয়নি। খালি ব্লকগুলো হচ্ছে ১, ২এ, ২বি, ৩এ, ৪এ, ৪বি, ৫, ৬এ, ২২এ, ২২বি এবং ২৩ নম্বর। এসব ব্লকে কাজ করতে যোগ্যতম বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে যৌথ কোম্পানি গঠন করে দরপত্রে অংশ নিতে পারবে। এ ছাড়া এ খাতের কোনো কোম্পানিকে ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগ দিয়ে কাজ করানোর সুযোগ রাখা হচ্ছে হালনাগাদ পিএসসিতে। স্থলভাগের গ্যাসের দামও বাড়ানো হচ্ছে বলে জানা গেছে। দেশের স্থলভাগে প্রথম পিএসসি করা হয় ১৯৯১ সালে। এর অধীনে শেভরন বিবিয়ানা, জালালাবাদ এবং মৌলভীবাজার গ্যাসক্ষেত্রের কাজ পায়। পরে ১৯৯৭ সালে সংশোধিত পিএসসির অধীনে কুমিল্লার বাঙ্গুরায় তাল্লো কাজ পায়। তবে কানাডিয়ান কোম্পানিকে টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্রের কাজ দেওয়া হয় পিএসসি ছাড়াই। বর্তমানে দেশের ২২টি গ্যাসক্ষেত্রের ১১৩টি কূপ দিয়ে দৈনিক ১ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুটের কিছু বেশি গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। গতকাল পেট্রোবাংলার গ্যাস উৎপাদনের চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এদিন এসব কূপ থেকে ১ হাজার ৭১৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন হয়েছে। এর সঙ্গে আমদানি করা ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি যোগ করে জাতীয় গ্রিডে মোট ২ হাজার ৭১৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে। স্থানীয়ভাবে সবচেয়ে বেশি গ্যাস উত্তোলন করা হয় সিলেটের বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে। মার্কিন কোম্পানি শেভরনের নিয়ন্ত্রণে থাকা এই গ্যাসক্ষেত্রের ২৬টি কূপ দিয়ে দৈনিক ৯৯১ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করে সরবরাহ করা হচ্ছে। এ ছাড়া শেভরনের নিয়ন্ত্রণে থাকা অন্য দুটি গ্যাসক্ষেত্রের মধ্যে জালালাবাদ ফিল্ডের সাতটি কূপ দিয়ে দৈনিক ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এবং মৌলভীবাজার গ্যাসক্ষেত্রের পাঁচটি কূপ দিয়ে দৈনিক সাড়ে ১৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এককভাবে শেভরন সবচেয়ে বেশি গ্যাস উত্তোলন ও সরবরাহ করছে। অন্য বহুজাতিক কোম্পানি তাল্লো বাঙ্গুরা গ্যাসক্ষেত্রের পাঁচটি কূপ দিয়ে দৈনিক ২১ মিলিয়ন গ্যাস উত্তোলন ও সরবরাহ করছে। দেশীয় কোম্পানি বাপেক্স আটটি গ্যাসক্ষেত্রের ১৫টি কূপ দিয়ে ১১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন ও সরবরাহ করছে। এই গ্যাসক্ষেত্রগুলো হচ্ছে সালদা, ফেঞ্চুগঞ্জ, শাহবাজপুর, সেমুতাং, শ্রীকাইল, বেগমগঞ্জ ও রূপগঞ্জ। সিলেট গ্যাসফিল্ড কোম্পানি (এসজিএফএল) সিলেট, কৈলাসটিলা-১, কৈলাসটিলা-২, রশিদপুর ও বিয়ানীবাজার এই পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্রের ১১টি কূপ দিয়ে দৈনিক ১১৭ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন ও সরবরাহ করছে। বাংলাদেশ গ্যাসফিল্ড কোম্পানি (বিজিএফসিএল) পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্রের ৪৪টি কূপ দিয়ে দৈনিক ৫৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন ও সরবরাহ করছে। গ্যাসক্ষেত্রগুলো হচ্ছে তিতাস, হবিগঞ্জ, বাখরাবাদ, নরসিংদী ও ম্যাগনামা। এর মধ্যে তিতাস গ্যাসক্ষেত্রটি সবচেয়ে পুরোনো।