সেরা করদাতা হিসেবে ‘করবাহাদুর’ পুরস্কার পেয়েছিলেন চাঁদ ডাইংয়ের কর্ণধার শিল্পপতি জসিম উদ্দিন মাসুম (৫৯)। গত বুধবার নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে পলিথিনে মোড়ানো সাত টুকরা লাশের পরিচয় নিশ্চিতের পর নড়েচড়ে বসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সেটি মাসুমের লাশের খণ্ডিত অংশ। গত রোববার মধ্যরাত থেকে ‘নিখোঁজ’ ছিলেন তিনি। বন্ধ ছিল তাঁর মোবাইল ফোন নম্বর। এই ঘটনায় পরদিন তাঁর বড় ছেলে গুলশান থানায় জিডি করেন। শেষ পর্যন্ত শিল্পপতি মাসুমের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করেছে পুলিশ। রুমা আক্তার নামে এক নারীর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। এরই মধ্যে কাফরুল থেকে রুমা, রুকুসহ চারজনকে আটক করা হয়েছে। হত্যা ও লাশ সরাতে রুমাকে সহায়তা করে তাঁর বান্ধবী রুকু। পরে রূপগঞ্জ থানায় হওয়া হত্যা মামলায় তাদের গ্রেপ্তার দেখানো এবং বাকি দু’জনকে জিজ্ঞাসাবাদের পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। নিহত মাসুম তাঁর পরিবার নিয়ে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বসবাস করতেন। তাঁর দুই ছেলে ও এক মেয়ে। তদন্তের সঙ্গে যুক্ত একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, হত্যাকাণ্ডের পর কাফরুলের বাসায় ছিলেন রুমা। নিরুদ্বেগ চলাফেরা ও ঘুমাতে থাকেন তিনি। বুধবার রাতে পুলিশ যখন ওই বাসায় যায়, তখনও তাঁকে ঘুম থেকে তুলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। প্রথমে এলোমেলো তথ্য দিলেও জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে সবকিছু স্বীকার করেন। ফ্যামিলি ট্যুর প্যাকেজ নিহতের পরিবারের সদস্য ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, রোববার বিকেলে মাসুম তাঁর বাসা থেকে বের হয়ে গুলশান যান। এর পর ব্যক্তিগত চালককে বাসায় ফিরে যাওয়ার কথা বলেন। মালেক নামে আরেক গাড়ির চালককে ডেকে নিয়ে নারায়ণঞ্জ যাওয়ার কথা ছিল তাঁর। রোববার রাত ১১টা পর্যন্ত মাসুমের মোবাইল ফোন নম্বর বন্ধ ছিল। কোনো খোঁজ না পেয়ে পরদিন সোমবার গুলশান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তাঁর বড় ছেলে ওবায়দুল ইসলাম শিবু। এর পর তদন্তে নামে পুলিশের একাধিক সংস্থা। বুধবার সকালে রূপগঞ্জ উপজেলার কাঞ্চন-কুড়িল বিশ্বরোড সড়কের উত্তর পাশে ৫ নম্বর সেক্টরের ব্রাহ্মণখালী এলাকায় লেকের পাড় থেকে পলিথিনে মোড়ানো অবস্থায় অজ্ঞাত এক ব্যক্তির লাশের সাত টুকরা উদ্ধার করে পুলিশ। তিনটি কালো পলিথিনের ব্যাগে করে অজ্ঞাত যুবকের মাথা, দুই হাত, শরীরের পেছনের অংশ, নাড়িভুঁড়ি, বাঁ পা ও বাঁ ঊরুর কাটা অংশ উদ্ধার করা হয়। এর পর নিশ্চিত হওয়া যায় ওই লাশের টুকরা মাসুমের। ফ্যামিলি ট্যুর প্যাকেজ দুই দশকের বেশি সময় ধরে ওই শিল্পপতির গাড়িচালক আবদুল মালেক। তিনি জানান, ‘নদী জলে শাপলা ভাসে’সহ দুটি সিনেমার প্রযোজক মাসুম। সিনেমা জগতে মিশতে গিয়ে অনেক নায়ক-নায়িকার সঙ্গে তাঁর পরিচয়। এর সূত্র ধরে রুমা আক্তার নামে এক নারীর সঙ্গে পরিচয় হয়। তাঁর বাসা কাফরুল। এর আগেও কয়েকবার ওই বাসায় গেছেন শিল্পপতি। তাঁর সন্ধান পেতে ঘটনার পর রুমার বাসায় গেলে তিনি জানান, রোববার বিকেলে সেখানে যান মাসুম। আধা ঘণ্টা পর বাসা থেকে চলে যান। সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে গোয়েন্দারা দেখেছেন, রোববার বিকেলে রুমার কাফরুলের ফ্ল্যাটে হাতে একটি ব্যাগ নিয়ে একাকী ঢুকেছেন মাসুম। এর পর তাঁকে আর বের হতে দেখা যায়নি। তবে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রুমা ও আরেক তরুণ দুটি ভারী ব্যাগ নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে আসেন। এর আগে তরুণকে ওই বাসায় ঢুকতে দেখা গেছে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে রুমা প্রথমে হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন। পরে ধীরে ধীরে ঠান্ডা মাথায় খুনের পর লাশ গুমের বর্ণনা দেন। তিনি দাবি করেন, কাফরুলের তিন কক্ষের ওই ফ্ল্যাটে তাঁর ছোট বোন, বান্ধবী, ভাবী ও তাঁর বাচ্চা থাকে। দুধের সঙ্গে চেতনানাশক মিশিয়ে অজ্ঞান করা হয় মাসুমকে। দু’দিন এভাবে থাকার পর মঙ্গলবার একটি কক্ষের বাথরুমে হত্যার পর লাশ ১১ টুকরা করা হয়। এর পর তাঁর এক বন্ধুকে দুটি ব্যাগ নিয়ে আসার কথা বলেন। দুটি ব্যাগে ভরে সাত টুকরা রূপগঞ্জের একটি লেকের পাড়ে এবং অন্য চারটি অংশ ৩০০ ফিট এলাকায় একটি কাশবনে ফেলে আসেন। গতকাল বৃহস্পতিবার রুমার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কাশবন থেকে চারটি টুকরা উদ্ধার করে পুলিশ। সেখানে হাত, পা ও কোমর থেকে বুকের খণ্ডিত অংশ ছিল। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে একেক সময় একেক কথা বলছেন রুমা। কখনও বলছেন, ‘সম্পর্কের’ জেরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। রুমার সঙ্গে শিল্পপতি মাসুমের ঘনিষ্ঠতা ছিল। এর পাশাপাশি মাসুম অন্য আরেক নারীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। বিষয়টি জানতে পেরে রাগ-ক্ষোভ ও আবেগের বশে তাঁকে খুন করে। ঘটনার দিন এক তরুণীকে নিয়ে মাসুম কাফরুলের বাসায় গিয়েছিলেন বলে দাবি করেন রুমা। তবে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে কোনো তরুণীকে নিয়ে বাসায় ঢুকতে দেখা যায়নি। রুমার ভাষ্য, মাসুমের হাতে যে ব্যাগ ছিল, সেটিতে ৫ কেজি গরুর মাংস ছিল। স্বজনসহ অনেকের প্রশ্ন, ফ্ল্যাটে আরও অনেক বাসিন্দা থাকলেও কীভাবে একাকী একজনকে হত্যার পর লাশ এত টুকরা করা হলো। রুমার দাবি, ফ্ল্যাটের অন্যরা খুনের বিষয়টি জানতেন না। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত চাপাতি, ব্লেড বনানীর ২০ নম্বর সড়কের একটি বাসায় রেখে আসেন রুমা। ওই বাসাটি মিউজিকের কাজে ব্যবহার করতেন তিনি। ওই বাসায় অভিযান চালিয়ে চাপাতি, ব্লেড ও মাসুমের কিছু কাপড়চোপড় জব্দ করা হয়েছে। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, প্রযুক্তিগত তদন্তে মঙ্গলবার রাতে রূপগঞ্জে রুমার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এতে ধারণা করা হচ্ছে, হত্যার পাশাপাশি লাশ গুমে সরাসরি জড়িত তিনি। অন্যদের সংশ্লিষ্টতা যাচাই নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে জেলা পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার বলেন, গ্রেপ্তার রুমা আক্তার ময়মনসিংহ গৌরিপুর থানার তারকান্দা এলাকার নজর আলীর মেয়ে। এ ঘটনায় রূপগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা হয়েছে। নিহতের বড় ছেলে ওবায়দুল ইসলাম শিবু তাঁর বাবার হত্যাকারীদের দ্রুত শনাক্ত করে বিচারের দাবি জানান। তিনি বলেন, আমার বাবাকে হত্যার পর যেভাবে টুকরা করে ফেলা হয়েছে, তা কোনোভাবে মেনে নিতে পারছি না।