রেলওয়ের তালিকায় গুরুত্বপূর্ণ বলা হলেও প্রকল্প চলছে ধীরগতিতে। রেলের তালিকা অনুযায়ী, চলমান ৩০টি উন্নয়ন প্রকল্পের আটটিই গতিহীন। তবে তালিকার বাইরে অন্তত তিনটি প্রকল্প রয়েছে, যেগুলোর মেয়াদ ফুরালেও কাজ শেষ হয়নি। বাকি প্রকল্পের কয়েকটির উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সংশোধন করে মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। সেগুলোও নির্ধারিত সময়ে শেষ হওয়া নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা। গতি বাড়াতে প্রকল্পের পরিচালকদের (পিডি) বদলির সুপারিশ করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। আজ মঙ্গলবার কমিটির ২৫তম সভা হবে। এর কার্যপত্রে বলা হয়েছে, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও অপচয় রোধে যেসব প্রকল্পের কাজ ধীরগতির সেগুলোর পিডি বদলের সুপারিশ করা হয় আগের সভায়। জবাবে রেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ধীরগতিসম্পন্ন প্রকল্পের তালিকা করা হয়েছে। নিয়মিত প্রকল্পের স্টিয়ারিং কমিটির (পিএসসি) সভা ও প্রকল্প পরিদর্শন করা হচ্ছে। ধীরগতির প্রকল্পের পিডিদের বদলির বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে। রেলের তালিকা অনুযায়ী ধীরগতির প্রকল্পগুলো হলো, ঠিকাদারের অর্থায়নে ৭০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন ক্রয়, ২০০টি মিটারগেজ প্যাসেঞ্জার ক্যারেজ ক্রয়, ২১টি মিটারগেজ ডিজেল ইঞ্জিন মেরামত, কুলাউড়া-শাহবাজপুর সেকশন পুনর্বাসন, আখাউড়া-আগরতলা ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণ, আখাউড়া-লাকসাম রেলপথকে ডুয়েলগেজ ডাবল লাইনে রূপান্তর, ঢাকা-টঙ্গী সেকশনে তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণ এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনে ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণ, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সেকশনে বিদ্যমান রেলপথের সমান্তরালে ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণ। এই আট প্রকল্পে খরচ ধরা হয়েছে ১২ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা। অগ্রগতি মাত্র ৩ দশমিক ২৩ শতাংশ। আখাউড়া-লাকসাম প্রকল্প ৯ বছরে ৮৮ শতাংশ এগিয়েছে। গত ৯ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেদিন এই প্রকল্পের কসবা-মন্দভাগ অংশে ট্রেন চলাচলের উদ্বোধন করেন, সেদিনই ভারতীয় সমীন্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) বাধায় বন্ধ হয় কিলোমিটার দেড়েক দূরের সালদানদী সেতু নির্মাণ। প্রকল্প মেয়াদ তৃতীয়বারের মতো বাড়িয়ে ২০২৪ সালে জুন করার প্রস্তাব করা হয়েছে। অথচ ২০২০ সালের জুনে কাজ শেষ করার পরিকল্পনা ছিল। কাজ বন্ধ হলেও খরচ কমে যাওয়ার বিরল ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে আখাউড়া-লাকসাম প্রকল্পে। ৬ হাজার ৫০৪ কোটি থেকে কমিয়ে প্রকল্প ব্যয় ৫ হাজার ৫৮৩ কোটি করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন মো. শহিদুল ইসলাম। তিনি গত ডিসেম্বরে পদোন্নতি পেয়ে রেলেওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালকে (অবকাঠামো) দায়িত্ব পেয়েছেন। নতুন পিডি মো. সুবক্তগীন বলেন, বিএসএফের বাধার কারণে কয়েক জায়গায় কাজ বন্ধ রয়েছে। বাধা না থাকলে চলতি বছরেই কাজ সম্পন্ন হবে। ৭০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন ক্রয় প্রকল্পটি ২০১১ সালের। ২ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকার এই প্রকল্প এগিয়েছে আধা শতাংশ। কাজ না হলেও বেতন-ভাতা বাবদ খরচ হয়ে গেছে ৫ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। ২০০টি মিটারগেজ প্যাসেঞ্জার ক্যারেজ ক্রয় প্রকল্প ২০১৬ সালের। সাত বছরে অগ্রগতি দশমিক শূন্য ১ শতাংশ! ২০১৬ সালে অনুমোদিত ২১ ইঞ্জিন মেরামতের প্রকল্পের অগ্রগতি শূন্য। প্রকল্পটি বাদ দিতে সুপারিশ করা হয়েছে। ভারতীয় ঋণে কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথ পুনর্বাসন প্রকল্প ২০১১ সালের জুলাইয়ে সরকারের অনুমোদন পায়। ৬৭৮ কোটি টাকার এই প্রকল্পে ৫৫৬ কোটি টাকা ঋণ দেবে ভারত। গত জুলাই পর্যন্ত প্রকল্প অগ্রগতি ছিল ২৪ দশমিক ৪১ শতাংশ। গত ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত এই সংখ্যা অপরিবর্তিত রয়েছে। অর্থাৎ সাত মাস কাজ বন্ধ। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে বন্ধ হওয়া ৫২ কিলোমিটার কুলাউড়া-শাহবাজপুর পুনর্বাসন কাজের ভারতীয় ঠিকাদার \'কালিন্দ রেল নির্মাণ\'। বারবার তাগিদ দিয়েও ঠিকাদারকে দিয়ে কাজ করাতে পারেনি রেল। কখনও করোনা, কখনও জমি, বিদ্যুতের খুঁটি বা গাছের অজুহাত দিয়েছে। ভারতীয় অনুদানে ৪৭৮ কোটি টাকায় আখাউড়া থেকে ১০ দশমিক ১ কিলোমিটার ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ সাত বছরে ৭০ শতাংশ এগিয়েছে। ১১ বছরে ঢাকা-টঙ্গী সেকশনে তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণ এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনে ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণে কাজ এগিয়েছে ৬৭ শতাংশ। গত ৯ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনে ট্রেন চলাচলের উদ্বোধন করেন। প্রকল্প পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী জুনে ঢাকা-টঙ্গী সেকশনে তৃতীয় ও চতুর্থ লাইনের কাজ সম্পন্ন হবে। তবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থার কারণে ২০২৪ সালের জুনের ঢাকা প্রকল্পটি কিছু অংশের কাজ করাই সম্ভব নয়। ১ হাজার ১০৬ কোটি টাকার এই প্রকল্পে ভারত ঋণ দেবে ৯০২ কোটি টাকা। এই বছর দেওয়ার কথা ২১৯ কোটি টাকা। তবে সাত মাসে এক পয়সাও দেয়নি। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সেকশনে বিদ্যমান রেলপথের সমান্তরালে ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণ প্রকল্পের মেয়াদ গত ডিসেম্বরে শেষ হয়েছে। কাজ এগিয়েছে ৮২ দশমিক ৬ শতাংশ। প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। তালিকার বাইরে থাকা খুলনা-মোংলা রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের মেয়াদ গত ডিসেম্বরে শেষ হয়েছে। কাজ এখনও ৩ দশমিক ৪ শতাংশ বাকি। ভারতীয় ঋণে ১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকায় পাবর্তীপুর-কাউনিয়া পর্যন্ত ৫৪ কিলোমিটার ডাবল লাইন নির্মাণ কাজও গত ডিসেম্বরে সম্পন্ন করার পরিকল্পনা ছিল। তবে পাঁচ বছরে প্রকল্পের অগ্রগতি দশমিক শূন্য শূন্য চার শতাংশ। অর্থাৎ কাজই শুরু হয়নি। বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প আগামী জুনে শেষ হওয়ার কথা। তবে এখনও নির্মাণকাজ শুরুই হয়নি। পাঁচ বছরে অগ্রগতি সাড়ে ৬ শতাংশ। অর্থাৎ সমীক্ষা ও নকশার কাজ চলছে। প্রকল্প পরিকল্পনা অনুযায়ী, জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী সেকশনে ডুয়েলগেজ প্রকল্প আগামী বছরের ডিসেম্বরে চালু হবে। তবে কাজই শুরু হয়নি। চার বছরে অগ্রগতি পৌনে সাত শতাংশ। চীন সরে যাওয়ার পর জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) ঋণে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জাইকা আবার সমীক্ষা করতে বলছে। বগুড়া-সিরাজগঞ্জ এবং জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী প্রকল্প আগামী পাঁচ বছরেও বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা নেই। সংসদীয় কমিটির সভায় পদ্মা রেল সংযোগ, দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ এবং চট্টগ্রাম বে-টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের অগ্রগতি ছাড়াও রেলওয়ের পতিত জমিতে চাষাবাদ বিষয়ে আলোচনা হবে। রেলের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন এলাকায় ৬০ শতাংশ জমিসহ বিভিন্ন এলাকায় ইতোমধ্যে চাষাবাদ শুরু হয়েছে।