গাজীপুরের বোর্ডবাজার এলাকার শামীম হোসেন (২৩)। ইতালিতে উচ্চাভিলাষী জীবনের প্রলোভনে গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর তাঁকে বাংলাদেশ থেকে দুবাই পাঠায় দালালরা। সেখান থেকে মিসর হয়ে লিবিয়ার বেনগাজি শহরে নিয়ে করা হয় জিম্মি। এর পর মুক্তিপণ আদায়ে শুরু হয় অবর্ণনীয় শারীরিক-মানসিক নির্যাতন। দীর্ঘ ১৫ মাস বন্দি থেকে সাড়ে ২৮ লাখ টাকার বিনিময়ে অবশেষে দেশে ফিরেছেন এই যুবক। ‘জীবন নিয়ে দেশে ফিরতে পেরেছি, এটা এখন স্বপ্নের মতো লাগে’ বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। শুধু শামীম নন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাচারের শিকার এমন মানুষের সংখ্যা হাজার হাজার। দালালরা প্রথমে তাদের বিদেশে উচ্চ বেতনে চাকরি, ভালো থাকার নানা প্রলোভন দেখায়। ফাঁদে পা দিলে কাঙ্ক্ষিত দেশের বদলে নেওয়া হয় অন্য দেশে। এর পর জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়ে চলে অমানুষিক নির্যাতন। লিবিয়া ও মরক্কো রয়েছে এমন দেশের তালিকায় প্রথম সারিতে। চক্রের হোতারা বিদেশে থাকায় তাদের গ্রেপ্তার ও বিচার হয় না বললেই চলে। মামলাও হয় না সব ক্ষেত্রে। ফলে নাগালের বাইরে থেকে দেশীয় সহযোগীদের দিয়ে বছরের পর বছর অমানবিক কারবার চালিয়ে যাচ্ছে একাধিক চক্র। দেশে মানব পাচার মামলা ও বিচারের হালহকিকত উঠে এসেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক-৩ শাখার এক প্রতিবেদনে। ওই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে তদন্তাধীন এবং আদালতে বিচারাধীন মানব পাচারের মামলা রয়েছে ৪ হাজার ১৪১টি। এর মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত (১০ মাস) ৯২৪টি নতুন মামলা হয়েছে। গত বছর এমন মামলার সংখ্যা ছিল ৮৫১টি (নভেম্বরের হিসাব ছাড়া)। এর আগে ২০২২ সালে ৬৯৭টি, ২০২১ সালে ৫৫৪টি (আগস্ট ছাড়া) এবং ২০২০ সালে ৫৩৩টি মামলা হয়। এই প্রতিবেদনে থানায় তদন্তাধীন মামলার বিবরণীতে দেখা যায়, নতুন-পুরোনো মিলিয়ে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত মানব পাচারের মামলার সংখ্যা ১ হাজার ৭৫০টি। এর মধ্যে পুলিশ ৫৪৫টিতে অভিযোগপত্র অথবা চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দিয়েছে। বর্তমানে তদন্তাধীন রয়েছে ১ হাজার ২০৫টি মামলা। এসব মামলায় ৩৮ হাজার ৪৫৯ আসামির মধ্যে ১৬ হাজার ১৮১ জন বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে। বাকিরা পলাতক অথবা জামিনে রয়েছে। প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বিচারে ধীরগতি এবং কম সাজার বিষয়টিও। প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে আদালত রায় দিয়েছেন মানব পাচারের ৩৩৬ মামলায়। এর মধ্যে মাত্র ১৯ মামলায় ৫০ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। বাকি ৩১৭ মামলায় খালাস পেয়েছেন ১ হাজার ১৭৮ আসামি। আগের বছর রায় হওয়া ৪৩৬ মামলার মধ্যে ২১টিতে ৭১ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়। বাকি ৪শর বেশি মামলায় ১ হাজার ৬১৭ আসামি মুক্তি পায়। এ ছাড়া ২০২২ সালে বিচার সম্পন্ন হওয়া ৩৭ মামলায় কোনো আসামির সাজা হয়নি। মুক্তি পায় ১২১ আসামি। ২০২১ সালে রায় হয় মাত্র দুটি মামলায়। সেখানেও কেউ সাজা পায়নি; খালাস পায় পাঁচজন। ২০২০ সালে বিচার শেষ হওয়া ১৪ মামলায় একজনের সাজা এবং ৪৩ আসামি মুক্তি পায়। ২০১৯ সালে ৩৯ রায়ে ৬৮ আসামি মুক্তি এবং ২৫ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা পায়। মানব পাচারের ঘটনায় গত ছয় বছরের (২০১৯-২০২৪) রায়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এই সময়ে ৩ হাজার ৫৫৯ নতুন মামলার বিপরীতে রায় হয়েছে মাত্র ৮৬৪টি। কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ড হয়নি। ২৪ জনকে যাবজ্জীবন এবং ১২৩ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে। আর খালাস পেয়েছে ৩ হাজার ৩২ আসামি। এর মধ্যে ২০২০ থেকে ২০২২ পর্যন্ত তিন বছরে মাত্র একজনের সাজা হয়। অথচ খালাস পায় ১৬৯ জন। সরকারি এই প্রতিবেদনের হিসাবে গরমিলও দেখা গেছে। মাসওয়ারি মামলার সংখ্যায় কমবেশি পাওয়া গেছে। সবচেয়ে বড় গোঁজামিলটা পাওয়া গেছে ২০২৩ সালে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে পুলিশি তদন্তাধীন মামলা যেখানে ছিল ৮২৬টি, ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে তা দেখানো হয়েছে ৪৩৪টি। লিবিয়ায় নির্যাতনের শিকার শামীম হোসেন জানান, প্রতিবেশী আকরাম হোসেন ও স্ত্রী শিখা বেগম তাঁকে ইতালিতে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করে দেয়। এতে যুক্ত শিখার বড় ভাই ইতালিপ্রবাসী বিল্লাল হোসেন ও ছোট দেবর নাজমুল হোসেন। বিভিন্ন দেশে এ চক্রের লোক রয়েছে। দুবাইয়ে তাদের হয়ে কাজ করেন নূর আলমসহ বেশ ক’জন। মিসরেও রয়েছে কয়েকজন। লিবিয়ায় এই চক্রের সদস্য আলাউদ্দিন ও রমজান। তারা ধাপে ধাপে পাচারের শিকার ব্যক্তিদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে। তিনি বলেন, চক্রটির সদস্যরা তাঁকে লিবিয়ার বেনগাজি শহরে নেওয়ার পর ইতালি পাঠানোর কথা বলে টাকা নেয়। এর পর লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলিতে অন্য আরেকটি চক্রের কাছে তাঁকে বিক্রি করে দেয়। ওই দলটি ২৩ দিন একটি অন্ধকার ঘরে আটকে রেখে তাঁর ওপর অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন চালায়। পরে তাদের ১১ লাখ টাকা দিয়ে মুক্তি পান তিনি। সব মিলিয়ে তাঁর কাছ থেকে ২৮ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে। এসব চক্রে সবাই বাংলাদেশি। শামীমের বাবা রজব আলী বলেন, একমাত্র ছেলে শামীম এসএসসি পরীক্ষার পর আর পড়ালেখা করেনি। প্রতিবেশীর প্রলোভনে পড়ে তাকে বিদেশ পাঠাতে গিয়ে সর্বস্ব হারিয়েছি। জমি পর্যন্ত লিখে দিতে হয়েছে মানব পাচার চক্রের সদস্যদের। ছেলেকে ফিরে পেলেও আর্থিকভাবে পঙ্গু হয়ে গেছি। শামীমের মতো আরেকজন রাজধানীর আগারগাঁও এলাকার মুদি দোকানি আয়নাল হক। নিজ দোকানের ক্রেতা সীমান্ত আহমেদ নামে একজনের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে স্পেনে পাড়ি দিতে দেশ ছাড়েন তিনি। তবে মানব পাচারকারী চক্র তাঁকে ফাঁদে ফেলে মরক্কোয়। সেখানে নির্যাতনের পর দেশ থেকে টাকা নিয়ে মানব পাচারকারীদের দেন তিনি। এক পর্যায়ে সুযোগ পেয়ে পালান আয়নাল। পরে কৌশলে স্পেনে পৌঁছান তিনি। মানব পাচার আইনে হওয়া মামলার অধিকাংশ আসামি খালাস পেয়ে যায়। এ বিষয়ে পুলিশের মুখপাত্র পুলিশ সুপার এনামুল হক সাগর বলেন, আসামির সাজা না হওয়ার অন্যতম কারণ হলো যথাসময়ে সাক্ষী হাজির না হওয়া। আবার অনেক সময় বাদী-বিবাদী নিজেদের মধ্যে বিষয়টি মীমাংসা করে ফেলেন। কোনো পক্ষ দেশের বাইরে থাকলেও বিচারের প্রক্রিয়াটি বাধাগ্রস্ত হয়। তিনি আরও বলেন, জিম্মি হওয়া ব্যক্তি যদি দেশের ভেতরে থাকে, তাহলে তাঁকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়। তবে দেশের বাইরে ঘটনা ঘটলে ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়ে।