চাঁদে চাষাবাদের উপায় খুঁজছেন তরিকুজ্জামান

প্রকাশিতঃ ডিসেম্বর ১৮, ২০২৪ | ৭:১৪ পূর্বাহ্ণ
আনোয়ার উদ্দিন কেন্দুয়া প্রতিনিধি নেত্রকোনা ময়মনসিংহ

আট ভাই-বোনের মধ্যে আমি সপ্তম। কেন্দুয়ার সান্দিকোনা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ ৪.৮৮ পেয়ে এসএসসি পাস করি। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়েছিলাম। পরে বুয়েটের শিক্ষক রেজাউল ভাইয়ের পরামর্শে কুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হলাম। মূলত দ্বিতীয় বর্ষ থেকেই গবেষক হওয়ার স্বপ্ন জাগে। চতুর্থ বর্ষে সেমিকন্ডাক্টর নিয়ে রিসার্চ এবং কার্বন ন্যানোটিউবের ওপর থিসিস করি। ২০১৪ সালে সিজিপিএ ৩.৪২ পেয়ে স্নাতক সম্পন্ন করি। চাকরির পাশাপাশি উচ্চশিক্ষা ঢাকায় এসে জিআরই দেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করলাম। রেজাল্ট পেতে খানিকটা সময় লাগবে। এই ফাঁকে একটি বেসরকারি কম্পানিতে যোগদান করি। কয়েক মাস পর খুলনায় সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে এনার্জিপ্যাক ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডে যোগদান করলাম। চাকরি ভালোই চলছিল। এসময় বন্ধুদের পরামর্শে তাদের নিয়ে কৃষি খামার ব্যবসায় নাম লেখালাম। তিন বছর পরও লসের পাল্লা ভারী হতে থাকায় ২০২০ সালে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলি। পাওনাদারদের চাপ বাড়তে থাকল। সময়টা কঠিন। পরে আবার জিআরই দিলাম। চাকরির সময় বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি প্রকল্পে কাজের অভিজ্ঞতা ছিল। লুইজিয়ানা টেক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. জোয়ান লাইনাম। বর্জ্য থেকে শক্তি উৎপাদন নিয়ে কাজ করেন। নিজের কাজের আদ্যোপান্ত জানিয়ে তাকে মেইল করলাম। ২০২১ সালের জুলাইয়ে লুইজিয়ানা টেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুলফান্ডেড স্কলারশিপসহ পিএইচডির অফার পেলাম। পরিত্যক্ত ভুট্টাগাছ থেকে ইথানল পিএইচডির বিষয় পরিত্যক্ত ভুট্টাগাছ থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি তৈরি। যুক্তরাষ্ট্রে ট্রান্সপোর্টশেন ফুয়েলের ১০ শতাংশ আসে এই ভুট্টা থেকে। গাঁজনপ্রক্রিয়ায় ভুট্টায় বিদ্যমান কার্বোহাইড্রেটকে ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে ভেঙে ইথানল তৈরি করা হয়। পরে সেটি ট্রান্সপোর্টশেন ফুয়েলের সঙ্গে মেশানো হয়। ভুট্টা মানুষ খায়। তা ছাড়া পশুর খাদ্য হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। তবে সব ভুট্টা ফুয়েল তৈরিতে ব্যবহৃত হলে একসময় মানুষ ও গবাদি পশুর খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে। আমার কাজ হচ্ছে, কিভাবে পরিত্যক্ত ভুট্টাগাছ থেকে ইথানল তৈরি করা যায় তা দেখা। এতে পরিবেশ দূষণমুক্ত করা যাবে। কেননা সাধারণ উপায়ে ভুট্টা পচে বায়ু ও পানি দূষণ করে। এ ছাড়া মিথেন গ্যাস নিঃসরণ করে, যা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। যেভাবে নাসায় পিএইচডির দ্বিতীয় বর্ষে ল্যাবে পরিচয় হলো আমেরিকান এক গ্র্যাজুয়েটের সঙ্গে। নাসার একটি প্রজেক্টে কাজ করছিলেন তিনি। সেখানে তাকে সাহায্য করি। আমার প্রফেসরও সামারে তার অ্যাকোয়াপনিকস সিস্টেমের মাছ প্রজেক্টে সাহায্য করতে বলেন। এ জন্য আমাকেও নাসার ফান্ড থেকে বৃত্তি দেওয়া হয়। কিভাবে পানি থেকে অ্যামোনিয়া গ্যাস কমানো যায়, সেটির উপায় বের করাই প্রকল্পের উদ্দেশ্য। অ্যামোনিয়া গ্যাসের কারণে মাছ চাষ ব্যাহত হয়। অ্যামোনিয়া গ্যাসকে কমিয়ে স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য সরাসরি কনট্রাক্ট মেমব্রেন ডিস্টিলেশন ব্যবহার করি। প্রক্রিয়াটি চাঁদে মাছ চাষের বিষয়টি মাথায় রেখে করা হয়। আমার একাগ্রতা, নিষ্ঠা এবং কাজের অগ্রগতি দেখে পরবর্তী বছর পিএইচডির মূল কাজের পাশাপাশি নাসার কাজে অন্তর্ভুক্ত করেন প্রফেসর। নাসার অনেকগুলো রিসার্চ সেন্টারের একটি হচ্ছে জন এফ কেনেডি স্পেস সেন্টার। এটি যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার মেরিট আইল্যান্ডে অবস্থিত। নাসার কিছু রিসার্চ এখানে সরাসরি করা হয়। বাকিগুলো বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির রিসার্চ গ্রুপকে দেওয়া হয়। ‘লা টেক বায়োমাস’ হচ্ছে তেমনই একটি রিসার্চ গ্রুপ, যা নাসার এই সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত। চাঁদে মাটিবিহীন চাষাবাদ ‘লা টেক বায়োমাস’ এর চার সদস্যের একজন আমি। প্রকল্পের বাকি সদস্যরা হলেন ড. আনি মেয়ার, ড. জোয়ান লাইনাম ও ড. মোহাম্মদ আমির ইকবাল। মানবমূত্র থেকে ইউরিয়া রিকভার করে তা দিয়ে কিভাবে শস্য উৎপাদন করা যায়, সেটি দেখাই হলো আমাদের কাজ। এতে নাসার টিম লিড সায়েন্টিস ড. আনি মেয়ার পরামর্শক। ড. জোয়ান লাইনাম কাজটি তদারকি করেন। নাসার পরিকল্পনায়, চাঁদে একটি বেইস ক্যাম্প বসানো হবে। চাঁদে নভোচারীদের বেঁচে থাকতে খাবারের প্রয়োজন এবং মানবসৃষ্ট বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা দরকার। মানবমূত্র থেকে আলাদাভাবে পানি ও ইউরিয়া রিকভার করা, সেই পানি পুনরায় পানযোগ্য করার বিষয়টিও গবেষণার অন্তর্গত। এ ক্ষেত্রে আমি সরাসরি কনট্রাক্ট মেমব্রেন ডিস্টিলেশন প্রক্রিয়া ব্যবহার করি। এতে সাশ্রয়ে ও কম শক্তি ব্যবহার করে ইউরিয়া ও পানযোগ্য পানি রিকভার করা যায়। প্রক্রিয়াটি ৮০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় করা হয়, যাতে ইউরিয়ার মলিকুলারগুলো ভেঙে না যায় এবং অন্যান্য মলিকুলারের ক্ষতি না হয়। এরপর ইউরিয়া এবং অন্যান্য মলিকুলার আলাদা করে পানিকে পুনরায় পানযোগ্য করলাম। ইউরিন থেকে পানি আলাদা করার পর এতে ইউরিয়ার ঘনত্ব বেড়ে যায়। এই অধিক ঘনত্বের ইউরিন সল্যুশনকে হাইড্রোকোনিক সিস্টেম (কোনো মাটি থাকবে না, শুধু পানি ও নিউট্রিয়েন্টগুলো থাকবে) ব্যবহার করে সুগার বিট উৎপাদন করা হয়। সুগার বিটে প্রচুর পরিমাণে সুগার থাকে, যা থেকে আবার ফুয়েলও তৈরি করা যায়। ফলে উৎপাদিত সুগার বিট মানুষের খাবারের পাশাপাশি এটি দিয়ে যানবাহনে ব্যবহার করা যাবে, যা চাঁদে বসবাসের পথ আরো সুগম করবে। সুগার বিট উৎপাদনের এই প্রক্রিয়ায় আর্টিফিশিয়াল লাইট ব্যবহার করে চাঁদের অনুরূপ পরিবেশ তৈরি করা হয়। এভাবে মানবমূত্র ব্যবহার করে মাটি ছাড়া মহাকাশে চাষবাসের সম্ভাবনাটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এখানে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। মানবমূত্রে সোডিয়াম ক্লোরাইড থাকে, যার প্রভাবে উদ্ভিদের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। আমরা এটিকে নিউট্রালাইজ করার চেষ্টা করছি। চাঁদে এই কার্যক্রম শুরু করতে ছয়-সাত বছরের মতো লাগতে পারে।