যুক্তরাজ্য সরকারের মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক, তার খালা বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাদের পরিবারে আরও কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে ৪০০ কোটি ডলার ঘুষ দেওয়ার অভিযোগে তদন্ত চলছে। ব্রিটেনের লেবার সরকারের মন্ত্রী টিউলিপ এ নিয়ে চাপের মুখে আছেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে কয়েক বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র চুক্তি ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের চুক্তি সইয়ের সময় তিনি সরকারি প্রতিনিধি দলের অংশ হিসেবে শেখ হাসিনার সঙ্গে ক্রেমলিনে যান। সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে বিরোধী রক্ষণশীলদের সরব হতে দেখা গেছে। তারা টিউলিপের মন্ত্রী পদে থাকা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন। স্থানীয় সময় বুধবার ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইল এ-সংক্রান্ত এক বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, মন্ত্রী টিউলিপের ওপর ব্রিটেনের আর্থিক খাতের দুর্নীতি দূরীকরণের দায়িত্ব ন্যস্ত থাকলেও তার বিরুদ্ধেই বাংলাদেশে দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত চলছে। বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন টিউলিপ ছাড়াও তার মা শেখ রেহানা সিদ্দিক ও খালা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত করছে। শেখ হাসিনা ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে লৌহকঠিন হাতে দেশ শাসন করেছেন। সহিংস বিক্ষোভে শত শত বেসামরিক মানুষ নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার প্রেক্ষাপটে গত আগস্টে তিনি ভারতে পালিয়ে যান। বাংলাদেশে হাইকোর্টের নির্দেশে তাদের বিরুদ্ধে এ তদন্ত শুরু হয়। হাইকোর্টের কাছে অভিযোগ পৌঁছেছে যে, টিউলিপ সিদ্দিক সম্ভবত রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তির মধ্যস্থতায় ছিলেন। সব মিলিয়ে ওই চুক্তির আর্থিক মূল্য ছিল ১০ বিলিয়ন বা ১ হাজার কোটি ডলার। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি করেছে রাশিয়ার রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত কোম্পানি রোসাটম। ইউক্রেন আগ্রাসনকে কেন্দ্র করে রাশিয়া ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে সম্পর্ক এখন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। ইউক্রেনকে আর্থিক ও অস্ত্র সহযোগিতা দিচ্ছে যুক্তরাজ্য, যা নিয়ে তীব্র অসন্তোষ রয়েছে রাশিয়ার। দুই দেশে একে অন্যকে আক্রমণ করে প্রায়ই নানা বিবৃতি-বক্তব্য দেয়। ২০১৩ সালে ক্রেমলিনে হাসিনা ও পুতিনের উপস্থিতিতে চুক্তিটি হয়। এ সময় টিউলিপ সিদ্দিকও উপস্থিত ছিলেন। তখন ব্রিটেনের লেবার পার্টির কাউন্সিলরের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। এই তিনজন ছাড়া দুদকের তদন্তের আওতায় আছেন খালাতো ভাই সজীব ওয়াজেদ জয়ও। এ নিয়ে বৃহস্পতিবার রাতে টিউলিপের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ডেইলি মেইল। এ সময় তিনি কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। তবে তার ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র বলছে, অভিযোগটি প্রথম মার্কিন ওয়েবসাইট ‘স্পুরিয়াস’-এ উঠে আসে। টিউলিপের পারিবারিক বন্ধু ও হাসিনার দল আওয়ামী লীগের যুক্তরাজ্য শাখার সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ফারুক বলেন, এসব অভিযোগ ‘বানোয়াট’। এগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এটা ছাড়াও মন্ত্রী হওয়ার পর টিউলিপের বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যে আরেকটি তদন্ত হয়েছে। দ্য মেইলের প্রতিবেদন জানায়, টিউলিপ ১৪ মাস ধরে লন্ডনে তার সম্পদের আয়ের তথ্য গোপন করেছেন। নিয়ম অনুযায়ী, ২৮ দিনের মধ্যেই এসব আয়ের তথ্য প্রকাশ করতে হয়। এর আগে একই পত্রিকা খবর প্রকাশ করে– পাঁচ কক্ষের ২০ লাখ পাউন্ডের একটি বাড়িতে টিউলিপ উঠেছেন। এ ক্ষেত্রে খালা শেখ হাসিনার রাজনৈতিক মিত্রতাকে কাজে লাগান তিনি। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে দুর্নীতি প্রসঙ্গে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমে দাবি করা হয়, যে ১ হাজার কোটি ডলার ঘুষের অভিযোগ উঠেছে, সেই অর্থের ৯০ শতাংশই ছিল ক্রেমলিনের কাছ থেকে তৎকালীন হাসিনা সরকারের ঋণ। এরই মধ্যে ৪০০ কোটি ডলার মালয়েশিয়ার ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে। শেখ হাসিনার শাসনামলকে মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের সময়কাল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তথাপি অতীতে টিউলিপ তার খালা হাসিনাকে ‘রোলমডেল’ বলে বর্ণনা করেছেন। তবে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর প্রকাশ্যে তিনি এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। টিউলিপের এমন অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন রক্ষণশীল দলের সংসদ সদস্য জো রবার্টসন। তিনি বলেন, ‘এটা পরিষ্কার যে, জটিল কিছু প্রশ্ন উঠেছে– যেগুলোর জবাব প্রয়োজন। আসলে ঘটনার সঙ্গে মন্ত্রীর (টিউলিপ) সম্পর্ক কোথায়?’ এ রকম অভিযোগ নিয়ে তিনি পদে থাকতে পারেন কিনা– এমন প্রশ্নও তোলেন এ রাজনীতিক। টিউলিপের বিরুদ্ধে এ অভিযোগের বিষয়টি ব্রিটেনের বাঙালি কমিউনিটির মধ্যেও ব্যাপক আলোচনার বিষয়। বিরোধীরা চাপ দিলেও নিজ দলকে পাশে পেয়েছেন টিউলিপ। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ১০ ডাউনিং স্ট্রিট থেকে এ-সংক্রান্ত বিবৃতিতে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী স্টারমারের আস্থা আছে টিউলিপের ওপর। টিউলিপ এ ধরনের ঘটনায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি বাংলাদেশসংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়ে এখন আর মাথা ঘামান না।