কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে গলায় জুতার মালা দিয়ে আবদুল হাই কানু নামের এক বীর মুক্তিযোদ্ধাকে লাঞ্ছনা করার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর দেশব্যাপী নিন্দার ঝড় উঠেছে। ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করতে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশ আসার পরই গতকাল সোমবার সকাল থেকে মাঠে অভিযান শুরু করেছে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক টিম। তবে ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পার হলেও পুলিশ কাউকে আটক করতে পারেনি। বিজয়ের মাসে মুক্তিযোদ্ধা কানুকে লাঞ্ছনা করার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে জড়িতদের গ্রেপ্তারে ১২ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা। ঘটনার ভিডিও ফুটেজ দেখে সাতজনকে শনাক্ত করা হয়েছে বলে থানা পুলিশ দাবি করেছে। তবে গ্রেপ্তার এড়াতে আগেই জড়িতরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছে। পুলিশ বলছে, সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে জড়িতদের প্রেপ্তারের নির্দেশ আসায় অভিযান চালাচ্ছে পুলিশের একাধিক টিম। স্থানীয় সূত্র বলছে, মুক্তিযোদ্ধা কানু ছিলেন উপজেলা কৃষক লীগের সভাপতি ও কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। সঙ্গে স্থানীয় সাবেক এমপি ও রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হকের সঙ্গে তাঁর দলীয় বিরোধ ছিল। এলাকায় ২০১৬ সালে যুবলীগ নেতা রানা হত্যা মামলায় কানু ও তাঁর ছেলে বিপ্লব ছিলেন চার্জশিটভুক্ত আসামি। এ মামলায় কানু গ্রেপ্তারও হন। এলাকার লোকজনের সঙ্গে বিরোধের জের ধরে এ ঘটনা ঘটেছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি। গত রোববার চৌদ্দগ্রামের নিজ এলাকা কুলিয়ারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে ওই মুক্তিযোদ্ধাকে লাঞ্ছিত করা হয়। জুতার মালা পরিয়ে এলাকা ত্যাগ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। পরে তিনি ফেনীতে চলে যান। তাঁর গ্রামের বাড়ি ঘটনাস্থলের অদূরে লুদিয়ারা গ্রামে। ২০১৬ সালে যুবলীগ নেতা রানা হত্যা মামলায় কানু ও তাঁর ছেলে বিপ্লব ছিলেন চার্জশিটভুক্ত আসামি। ভিডিও বক্তব্যে যা বললেন মুক্তিযোদ্ধা কানু গতকাল সোমবার বিকেলে ফেনী থেকে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে একটি ভিডিও বক্তব্য গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। এতে আবদুল হাই কানু বলেন, আমি বীর মুক্তিযোদ্ধা। ৩০০ টাকার স্ট্যাম্প এনে ওরা বলে– তুই আর মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিবি না। টিপ দে, স্বাক্ষর দে। আমি বলেছি, আমার জীবন গেলেও স্বাক্ষর দেব না। এ সময় আমার শরীরে ওরা কিল-ঘুসি মারে। জোর করে জুতার মালা পরিয়ে দেয়। বিকেল ৫টার মধ্যে বাড়ি না ছাড়লে বাবা-ছেলের হাড়-মাংস খুঁজে পাওয়া যাবে না বলে হুমকি দেওয়া হয়। আমি বলেছি, আমি মুক্তিযোদ্ধা; জীবন গেলেও বাড়ি ছাড়ব না। পরে মান-ইজ্জতের ভয়ে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হই। আমার গলায় জুতার মালা পরানো মানে মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা দেওয়ার সমান। প্রেস উইংয়ের বিবৃতি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই কানুর মানহানির ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং। গতকাল সোমবার সকালে এক বিবৃতিতে এ নিন্দা জানানো হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, ইতোমধ্যে পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনকে ঘটনার তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কানুর বিরুদ্ধে হত্যাসহ ৯টি মামলা রয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। তবে আমরা সবাইকে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। অস্বীকার জামায়াতের এদিকে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের সবাই জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে কানুর পরিবার থেকে অভিযোগ করা হলেও চৌদ্দগ্রাম উপজেলা জামায়াতের আমির মাহফুজুর রহমান বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। সোমবার তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধা লাঞ্ছিত করার সঙ্গে জামায়াতকে জড়িত করা হচ্ছে। এ সঙ্গে স্থানীয় জামায়াতের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। ঘটনার সময় সেখানে উপস্থিত প্রবাসী আবুল হাসেমসহ যাদের ভিডিওতে দেখা গেছে, তারা আমাদের দলের কোনো পদে নেই। ব্যক্তিগত ক্ষোভ কিংবা বিরোধ থেকে এ ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে। যারা জড়িত, জামায়াত তাদের গ্রেপ্তার চায়। এ ঘটনায় দুই সমর্থককে বহিষ্কার করেছে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা জামায়াত। তারা হলেন মু. আবুল হাশেম ও মু. অহিদুর রহমান। তবে কানুর ছেলে স্থানীয় বাতিসা ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়ার দাবি, ‘স্থানীয় জামায়াত সমর্থক প্রবাসী আবুল হাসেমের নেতৃত্বে অহিদ, পেয়ার, বেলাল, ইসমাইল, রাসেল, ফারহান, ফরহাদ, নয়নসহ ১৫-২০ জন আমার অসুস্থ বাবাকে স্থানীয় পাতড্ডা বাজার থেকে ধরে নিয়ে লাঞ্ছিত করে।’ মুক্তিযোদ্ধাদের বিক্ষোভ আজ জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা সফিউল আহমেদ বাবুল বলেন, একজন মুক্তিযোদ্ধাকে প্রকাশ্যে জুতার মালা গলায় দিয়ে লাঞ্ছিত করার প্রতিবাদ জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই। চৌদ্দগ্রাম উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার প্রমথ রঞ্জন জানান, মঙ্গলবার (আজ) মুক্তিযোদ্ধারা উপজেলা সদরে বিক্ষোভ সমাবেশ করবেন। কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরফাতুল ইসলাম বলেন, জড়িতদের শনাক্ত ও আটকের চেষ্টা চলছে। গতকাল রাতে চৌদ্দগ্রাম থানার ওসি এ টি এম আক্তারুজ্জামান বলেন, লাঞ্ছিত মুক্তিযোদ্ধার পক্ষ থেকে এখনও থানায় অভিযোগ দেওয়া হয়নি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, হিংসার বশবর্তী হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানহানি হতাশাজনক।