চোখ ধাঁধানো বিলবোর্ড বসিয়ে ৫ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার মিশন

প্রকাশিতঃ ডিসেম্বর ২৮, ২০২৪ | ১০:৫৩ পূর্বাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

রাজধানীর অদূরে মহাসড়কের পাশে অল্প কিছু জমি কিনে গ্রাহকদের অভিনব প্রতারণার ফাঁদে ফেলছে আবাসন কোম্পানি সুমনা হাউজিং। প্রতারণার কৌশল বাস্তবায়নে চোখ ধাঁধানো বিলবোর্ড বসিয়ে আকর্ষণীয় অফারের বিজ্ঞাপন দিচ্ছে এ কোম্পানি। জানা গেছে, ঢাকা নগরী থেকে মাত্র ৮ কিলোমিটার দূরে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের পাশে কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের পেছনে গড়ে উঠছে সুমনা হাউজিং আবাসন প্রকল্প। আধুনিক শহরের স্বপ্ন দেখিয়ে প্রকল্পের ম্যাপ আর সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে আগামী ১০ বছরে ৫ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনায় মাঠে নেমেছে কোম্পানিটি। নিজস্ব অল্প কিছু জমি কিনে বাকি জমি দখল এবং ভরাট করে বার্ষিক চুক্তিতে ভাড়া নিয়ে চোখধাঁধানো সাইনবোর্ড টাঙিয়ে আকর্ষণীয় দামে প্লট বিক্রির নামে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে সুমনা হাউজিং। একযুগ আগে এই প্রজেক্টের যাত্রা শুরু। কিন্তু আজও কোনো গ্রাহককে জমি বুঝিয়ে দিতে পারেনি তারা। এই আবাসন প্রকল্পে এককালীন মূল্য পরিশোধে বিশাল ছাড়, ফ্রি ডিনার সেট, স্ক্র্যাচ কার্ড ঘষলেই লাখ টাকা পর্যন্ত ছাড়-এমন চমৎকার বিজ্ঞাপন দিয়ে ঢাকা শহরের নামিদামি হোটেলে কয়েকদিন পর পর আবাসন মেলা করে গ্রাহকের কাছে সহজ কিস্তিতে প্লট বুকিংয়ের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এতে প্রলুব্ধ হয়ে ফাঁদে পা দিয়েছে অনেক মানুষ। প্রতারণা বুঝতে পেরে অনেক গ্রাহক টাকা ফেরত চাইলে টালবাহানা করছেন মালিকপক্ষ। শতাংশ প্রতি ৩ হাজার টাকা নির্ধারণ করে ৪ কাঠা বা ৬ কাঠা সাইজের প্রতিটি প্লটের জন্য গ্রাহকপ্রতি মাসিক কিস্তি নিচ্ছে ১৮ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা। বছরে ২ লাখ ১৬ হাজার থেকে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। ১০ বছরে ২১ লাখ ৬০ হাজার থেকে ৩৬ লাখ টাকা পর্যন্ত। এভাবে তাদের টার্গেটকৃত গ্রাহকের নিকট থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে ৫ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনায় কাজ করছে সুমনা হাউজিং কোম্পানি। কিন্তু ১০ বছর পর গ্রাহকদের কোথায় কীভাবে কোন প্লট বুঝিয়ে দেওয়া হবে, তা একমাত্র তারাই জানেন। কারণ গ্রাহকরা যে ডুকমেন্টের ওপরে নির্ভর করে টাকা দিচ্ছেন তা এক হাজার বছরেও ফেরত পাবেন কিনা সন্দেহ রয়েছে। আবাসন ব্যবসায়ী ও কর্মকর্তারা বলছেন, এই নিয়মে প্লট পাবে না ৯৮ শতাংশ গ্রাহক। অনুসন্ধানে জানা গেছে, টেলিভিশন ও পত্রিকার পাতায় লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে সাধারণ জনগণকে প্রলুব্ধ করে আবাসন মেলার আয়োজন করে সুমনা হাউজিং। মেলায় দীর্ঘমেয়াদি ও সহজ কিস্তির মাধ্যমে কোনো প্রকার ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই প্লট বুকিংয়ের সুবিধা প্রদান করেছে। যারা এই বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পা দিয়ে প্লট বুকিং দিয়েছে তারা অদূর ভবিষ্যতে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন সচেতন জনগণ। কারণ কোম্পানির দেওয়া টাকা গ্রহণের রশিদ দিয়ে কোনো সময়ই টাকা ফেরত পাবে না। আর কোম্পানিও প্লট বা টাকা ফেরত দিতে পারবে না। মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসন কিংবা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কারও অনুমতি নেই। নেই আবাসন প্রকল্প করার পর্যাপ্ত জমি। তবুও শুধুই প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার জন্য বিভিন্ন হোটেলে একক আবাসন মেলার আয়োজন করে। আর এই মেলার নামে নানারকম বিজ্ঞাপন প্রচার করে। মানুষের স্বপ্ন নিয়ে এই কোম্পানির অভিনব প্রতারণা, অনুমোদন ছাড়াই প্লট বিক্রির বাহারি বিজ্ঞাপন নিয়ে মানুষের ক্ষোভের শেষ নেই। মতিঝিলের হোটেল পূর্বাণী ইন্টারন্যাশনাল ও বিভিন্ন তারকা মানের হোটেলে প্রায়ই আবাসন মেলার আয়োজন করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে সুমনা হাউজিং। মুন্সীগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সুমনা হাউজিং’ পরিবেশ ছাড়পত্র গ্রহণ তো দূরের কথা আবেদন পর্যন্ত করেনি। তবে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না-এ ব্যাপারে সদুত্তর না দিয়ে বলেন, ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনে ব্যবস্থা নেওয়ার সময় এসেছে, এখন নেওয়া হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুমনা হাউজিং আবাসন প্রকল্পের এক কর্মকর্তা বলেন, সুমনা হাউজিংয়ের নিজস্ব জমির পরিমাণ মাত্র কয়েক বিঘা। যেসব জমির ওপর সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে তার ৯০ ভাগই অন্যের কাছ থেকে মাসিক ভাড়ায় নেওয়া হয়েছে। কারণ আবাসন প্রকল্প বানাতে গেলে যে পরিমাণ জমি প্রয়োজন তা কোম্পানির নেই। মূলত তারা চটকদার বিজ্ঞাপনে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করে এ প্রতারণা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি কান্তা কবির বলেছেন, ঢাকার ওপর চাপ কমাতে কেরানীগঞ্জে পরিকল্পিত আবাসিক এলাকার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু ২০১৪ সালের পর থেকে কেরানীগঞ্জের সর্বত্র ছোট-বড়-মাঝারি এত অনিয়ন্ত্রিত আবাসন হয়েছে যে পরিস্থিতি এখন মারাত্মক হয়ে উঠেছে। এই অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ প্রতিরোধ করতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) জোরালো ভূমিকা নেওয়া উচিত। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে রাজউকের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. ছিদ্দিকুর রহমান সরকার (অব.) বলেন, এখন থেকে রাজউকের অনুমোদনহীন ভুঁইফোঁড় কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে। আর এ ধরনের কোনো প্রকল্প হতে দেওয়া হবে না। রাজউক এদের রাশ টেনে ধরবে। অভিযোগের বিষয়ে সুমনা হাউজিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বশির আলম মৃধাকে টেলিফোনে একাধিকবার কল করে, মেসেজ দিয়ে এবং অফিসে গিয়েও কথা বলা সম্ভব হয়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অফিসের একজন কর্মচারী বলেন, ৫ আগস্টের পর তিনি গা ঢাকা দিয়ে আছেন। কারণ স্থানীয় ভূমিদস্যু শাহিন চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন বশির।