ছাত্র-জনতার প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে ১৬টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সেখানে নগরায়ণ বা নগর সংস্কারসংক্রান্ত কোনো কমিশন গঠন করা হয়নি। স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন নামে একটি সংস্কার কমিশন গঠন করা হলেও এতে কোনো নগর পরিকল্পনাবিদ বা নগর বিশেষজ্ঞ রাখা হয়নি। ওই কমিশন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করলেও এখনো নগর পরিকল্পনাবিদ, প্রকৌশলী বা স্থপতিদের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক মতামত গ্রহণ করেনি। বিশেষজ্ঞদের মতে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দেশের নগরায়ণের রুগ্ণদশা থেকে উত্তরণে ভূমিকা রাখতে হবে। নতুন করে কমিশন গঠন করা সম্ভব না হলেও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের আওতায় নগরায়ণসংক্রান্ত সংস্কারের কার্যকর সুপারিশ করতে হবে। এটা হতে পারে কমিশনের নাম পরিবর্তন করে ‘স্থানীয় সরকার ও নগর সংস্কার কমিশন’ করা এবং ওই কমিশনে নগর পরিকল্পনাবিদ বা নগর বিশেষজ্ঞ এক বা একাধিক সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করে প্রয়োজনীয় সুপারিশগুলো কার্যকরভাবে উপস্থাপন করতে হবে। এ প্রসঙ্গে নগর গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান নগরবিদ অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম বলেন, নগর পরিকল্পনা ও নগরায়ণ খুবই জরুরি বিষয়। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো পরিকল্পিত উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে এটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। তিনি বলেন, নগরনীতি এবং এ সংক্রান্ত কিছু ডকুমেন্টস তৈরি করা রয়েছে। স্থানীয় সরকার কমিশন সেগুলোকে যাচাই-বাছাই করে দেখতে পারে। এজন্য ওই কমিটিতে এক বা একাধিক নগর পরিকল্পনাবিদ বা বিশেষজ্ঞকে যুক্ত করে নিতে পারে। এ কাজে কমিশনকে সবচেয়ে ভালো সহায়তা দিতে পারবে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত হবে নগরায়ণ ইস্যুটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখা। কেননা এই বিষয়টিকে অবহেলা করে পরিকল্পিত, পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই উন্নয়ন করা সম্ভব হবে না। জানা গেছে, পরিকল্পিত ও টেকসই উন্নয়নের জন্য বিশ্বব্যাপী ‘নগর পরিকল্পনা’র নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে এবং এটাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এর মধ্যে প্রথমে জাতীয় ভৌত বা স্থানিক পরিকল্পনা করা হয়, তারপর আঞ্চলিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয় এবং সবশেষ স্থানীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়ে থাকে। এই পদ্ধতি অনুসরণে উন্নয়ন কাজে কৃষি, জীববৈচিত্র্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ঠিক রেখে টেকসই উন্নয়ন কাজ করা যায়। পৃথিবীজুড়ে স্বীকৃত এই পদ্ধতির বাংলাদেশে চর্চা নেই বলে অভিমত নগরসংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে, দেশে অপরিকল্পিতভাবে খেয়াল-খুশির উন্নয়ন কাজ চলছে। এতে করে একদিকে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার অপচয় ঘটছে এবং বিশৃঙ্খল উন্নয়নে দেশের পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংস হচ্ছে। স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও সারা দেশের জন্য জাতীয় ভৌত বা স্থানিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়নি। তারা জানান, অপরিকল্পিত উন্নয়নের পাগলা ঘোড়া দেশ স্বাধীনের পর থেকে এখনো চলমান। অপরিকল্পিতভাবে বিশৃঙ্খল উন্নয়নের ফলে বিশ্বের অন্যতম জনবহুল শহর রাজধানী ঢাকা বসবাসের অযোগ্য নগরে পরিণত হয়েছে। একই অবস্থা বিরাজ করছে দেশের ৬৪টি জেলা, ৪৯৫টি উপজেলাসহ প্রায় ৬০০টি নগরকেন্দ্রের। এসব নগর, শহর এবং নগরকেন্দ্রে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ বসবাস করছে। এ বিষয়ে স্থপতি এবং নগর বিশেষজ্ঞ ইকবাল হাবিব বলেন, স্থানীয় সরকার কমিশনের আওতায় নগরায়ণসংক্রান্ত সংস্কারগুলো করা হচ্ছে। সেখানে কোনো নগরপরিকল্পনাবিদ ও নগর নকশাকার (স্থপতি) না রাখার মাধ্যমে সংস্কার কাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হলো। ড. তোফায়েল আহমেদের মতো একজন বিজ্ঞ লোক থাকার পরও এটা হওয়া খুবই দুঃখজনক। তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার কমিশনের অন্য সদস্যদের মাধ্যমে দেশের নগরায়ণের সমস্যা এবং উত্তরণের উপায়গুলো সঠিকভাবে তুলে ধরা সম্ভব হবে না। আরও দুঃখজনক ব্যাপার হলো, এই কমিশনের বড় অংশজুড়ে নগর হলেও এখন পর্যন্ত কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে নগরপরিকল্পনাবিদ বা স্থপতিদের সঙ্গে কোনো মতবিনিময় করেনি। এই দুর্বলতা নিয়ে কমিশন এগোতে থাকলে সেখানে স্থানীয় সমস্যা ও সমাধানের উপায়গুলো কমিশনের সুপারিশে যথাযথভাবে উঠে আসবে না। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বিশ্বের উন্নত দেশগুলো নগরায়ণ ইস্যুটিকে এক নম্বরে স্থান দিয়ে থাকে; সেখানে বাংলাদেশে তার স্থান তলানিতে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত ছিল নগর ইস্যুতে স্বতন্ত্র সংস্কার কমিশন করা। কিন্তু সেটা করেনি; সরকার চাইলে ‘স্থানীয় সরকার ও নগর সংস্কার’ নামেও কমিশন করতে পারত। সরকারের কাছে বিষয়টি খুবই অগুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় কোথাও এর স্থান হয়নি। তিনি জানান, স্থানীয় সরকার কমিশন চাইলেও সেখানে নগরপরিকল্পনাবিদ বা নগর বিশেষজ্ঞদের যুক্ত করে সেই শূন্যতা পূরণ করতে পারত। কিন্তু তারা সেটা করেনি; উপরন্তু ওই কমিশন এখন পর্যন্ত নগরসংশ্লিষ্ট কারও সঙ্গে বা কোনো পেশাজীবীর সঙ্গে মতামতও গ্রহণ করেনি। এটা বর্তমান সরকারের কাছ থেকে একটি ভুল বার্তা পাচ্ছে দেশের মানুষ, এটা খুবই দুঃখজনক ব্যাপার। অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৮ সালে প্রণীত দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ভৌত পরিকল্পনার জন্য নগর ও গ্রাম পরিকল্পনা আইন প্রণয়নের কথা বলা হয়। এর আওতায় জাতীয় ভৌত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে এবং তা কার্যকরের জন্য জাতীয় ভৌত পরিকল্পনা কাউন্সিলর গঠনেরও কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে ভৌত পরিকল্পনা অধিদপ্তর বা নগর ও গ্রাম পরিকল্পনা অধিদপ্তর গঠনের কথা বলা হয়; সেটা কাউন্সিলের সভাপতির সচিবালয় হিসাবে কাজ করবে। আর এটির নেতৃত্বে থাকবেন সরকারপ্রধান। ৫৩ বছর ধরে এই উদ্যোগ গ্রহণ না করায় দেশে বিশৃঙ্খল উন্নয়ন হয়েছে। যার ফলে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিত বাংলাদেশ। বর্তমানে জাতীয় ভৌত পরিকল্পনার বদলে বিশ্বজুড়ে এখন স্থানিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হচ্ছে। কমিশনের বক্তব্য : নগরায়ণসংক্রান্ত বিষয়ে জানতে চাইলে সোমবার স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, দেশের নগর সম্প্রসারণ ঘটছে। আগামী ১০ বছর বা দ্রুততম সময়ে দেশের সিংহভাগ এলাকা নগরায়ণের আওতায় চলে আসবে। এজন্য ভবিষ্যতে স্থানীয় সরকারের স্তরগুলোকে কমিয়েও আনার সুযোগ সৃষ্টি হবে। তিনি বলেন, দেশে দুই ধরনের সরকার রয়েছে, এর একটি কেন্দ্রীয় সরকার এবং অন্যটি স্থানীয় সরকার। স্থানীয় সরকারকে ঢেলে সাজাতে কাজ করতে হবে এবং এটাকে গুরুত্ব দিতে হবে। স্বায়ত্তশাসিত হলেও অর্থায়ন বন্ধ করা যাবে না। তিনি জানান, কেন্দ্রীয় সরকার সব ধরনের ট্যাক্স আদায় করে থাকে। সেখান থেকে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে বরাদ্দ দিতে হবে। তাহলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হবে, সেখানে মেধাবীরা চাকরি নেবে এবং একটি শক্তিশালী কাঠামো গড়ে উঠবে। তখন এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কার্যকরভাবে জনগণের সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এছাড়া দেশের অনেক পৌরসভার আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। অনেক পৌরসভার মাসের পর মাস বেতন বাকি; এগুলো বিলুপ্ত করা যায় কি না তা ভেবে দেখতে হবে। পৌরসভাগুলোকে ইউনিয়ন পরিষদের সঙ্গে একীভূত করা যায় কি না তা নিয়েও সংস্কার কমিশন ভাবছে। একই সঙ্গে পৌরসভাসহ স্থানীয় সরকারের স্তরগুলোকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করে স্বতন্ত্র সার্ভিস কাঠামো গড়ে তোলার সুপারিশ করব; এটা ক্যাডার বা নন-ক্যাডার যে কোনোটি হতে পারে। স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের আওতায় নগরায়ণের বড় ইস্যু সংশ্লিষ্ট রয়েছে। কিন্তু সংস্কার কমিশনে কোনো নগর পরিকল্পনাবিদ বা স্থপতি রাখা হলো না কেন, এ প্রসঙ্গে কমিশনের সদস্য অ্যাডভোকেট আব্দুর রহমান বলেন, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনে নগরায়ণের বড় ইস্যু জড়িত এটা সত্য। তবে কেন নগরপরিকল্পনাবিদ বা নগর বিশেষজ্ঞ রাখা হয়নি, এটা তোফায়েল স্যার ভালো বলতে পারবেন। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য মঙ্গলবার ‘স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার মতামত নেওয়া সম্ভব হয়নি।