সেদিনের সেই দুর্ঘটনার কথা বলতে এখন আর গলা বুজে আসে না আবদুল মতিনের। হুইলচেয়ারের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া জীবনে এক রকম আত্মবিশ্বাস জন্মেছে তাঁর। ৯ বছর আগে আর্জেন্টিনার পতাকা টানাতে গিয়ে দুই হাত, দুই পা হারানো মতিনের গর্ব– তাঁকে মনে রেখেছে মেসির দেশ। তাঁকে সম্মান দেখিয়েছেন ঢাকায় আসা আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সান্তিয়াগো আন্দ্রেস ক্যাফিয়েরো। ঢাকায় দূতাবাস খোলার অনুষ্ঠানে ফেনীর দাগনভূঞার মতিনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বুয়েন্স আয়ার্স থেকে আসা সাংবাদিকের দল থেকে শুরু করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী– সবার কৌতূহল ছিল মতিনকে ঘিরে। জানতে চাওয়া হয়েছিল তাঁর কোনো ইচ্ছার কথা– হৃদয়ে লালিত স্বপ্নের কথা বলতে দ্বিধা করেননি মতিন। ‘আপনারা শুধু মেসির কাছে আমার নামটি পৌঁছে দিয়েন। তাঁকে বলে দিয়েন, বাংলাদেশে তাঁর এক ভক্ত কতটা ভালোবাসে তাঁকে। মেসি যদি তা শুনে কোনো দিন আমার খোঁজ করেন, তাতেই আমার জীবন ধন্য হয়ে যাবে।’ আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মতিনকে আশ্বাস দিয়েছেন, তিনি মতিনের বার্তা পৌঁছে দেবেন মেসির কাছে। আর্জেন্টিনাকে নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের আবেগ আর ভালোবাসার কথা জানা আছে সান্তিয়াগোর। তার পরও মতিনের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তাঁর দেশ সম্পর্কে ফুটবল ছাড়া আর কিছু জানেন কি তিনি? মতিনের উত্তর, ‘কীভাবে জানব, আমি তো কখনও আর্জেন্টিনা যাইনি। যদি কখনও সুযোগ হয়, তাহলে দেখতে চাই সে দেশকে।’ মতিনের কথা শুনে উপস্থিত আর্জেন্টিনার সাংবাদিকরা আশ্বস্ত করেছেন তাঁকে– তাঁদের দেশে ঘুরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হবে। ‘আমার মতো মানুষকে তাঁরা যে সম্মান দেখিয়েছেন, তাতে আমি গর্বিত। বাংলাদেশ আর আর্জেন্টিনার মধ্যে তাঁরা যে বন্ধন তৈরি করেছেন, তাতে আমার নাম জড়িয়ে রয়েছে। এই আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।’ আর্জেন্টিনার দূতাবাস উদ্বোধন অনুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে এভাবেই মনের কথা কাছে খুলে বলছিলেন মতিন। মন্ত্রীর উপহার দেওয়া আর্জেন্টিনার থ্রি স্টার জার্সিটা তখনও জড়িয়ে তাঁর গায়ে। ‘জানি না, মেসির সঙ্গে কোনো দিন দেখা হবে কিনা। আমার মতো সারা বিশ্বে তাঁর অগুনিত ভক্ত রয়েছে। তার পরও যদি কোনোভাবে আমার নামটা অন্তত তিনি জানেন, যদি কখনও সুযোগ হয় তাঁর সামনে যাওয়ার...।’ তাহলে কী উপহার দেবেন তাঁকে? উত্তর দিতে গিয়ে মনে হচ্ছিল নিজের সবচেয়ে বড় সম্পদ কী– তা ভেবে দেখছেন, ‘আমি তো হাত-পা হারানো একজন মানুষ। কী-ই বা দেব মেসিকে। তবে যদি সত্যিই কোনো দিন সেই সুযোগ হয়, তাহলে আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয়, সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদও তাঁকে দিতে প্রস্তুত।’ হুইলচেয়ারে বসেই তিনি এখন ফেসবুকে ‘মতিন আর্জেন্টিনা’ নামে নিজের একটি পেজ চালান। কাতার বিশ্বকাপের সময় তাঁর এই ফেসবুক পেজই আর্জেন্টিনার মিডিয়ার চোখে ধরা পড়ে। তাঁকে নিয়ে তখন সেখানকার মিডিয়ায় বেশ কিছু খবর প্রচারিত হয়। তখনই তা নজর কাড়ে আর্জেন্টিনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। ভিডিও কনটেন্ট বানানোই এখন তাঁর পেশা। ২০১৪ সালের ২৮ মার্চ আর ২০২২ সালের ১৮ ডিসেম্বর– জীবনের সবচেয়ে কষ্ট আর সুখের দিন মতিনের কাছে। গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর যখন মেসির হাতে বিশ্বকাপ ট্রফি ওঠে, সেটা ছিল মতিনের জীবনের সবচেয়ে সুখের মুহূর্ত। আর ২০১৪ সালের ২৮ মার্চ– সেদিন লক্ষ্মীপুর শহরের আজিম শাহ মার্কেটের তিনতলা ছাদের ওপর অ্যালুমিনিয়াম রডের মাধ্যমে আর্জেন্টিনার পতাকা লাগাতে যান মতিন। হঠাৎ বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের সঙ্গে লেগে যায় অ্যালুমিনিয়ামের রডটি। ‘মুহূর্তেই ছিটকে পড়ি একটি দেয়ালের ওপর, তখন আমার জ্ঞান ছিল না। এর পর সেখানকার দোকানদাররা উদ্ধার করে সদর হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে, ২৭ দিন আইসিইউতে ছিলাম। তিন মাস চিকিৎসা চলছে। ইনফেকশন হয়ে যাওয়ায় হাত-পা কেটে ফেলতে হয়। পুরো চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে হয়েছে। একটা ব্যবসা ছিল, দোকান ছিল– চিকিৎসা করাতে গিয়ে সব শেষ। আর্জেন্টাইন সাংবাদিকরা জানতে চেয়েছিলেন সেই সময়কার কথা। তাঁদের বলেছি, ‘সব হারিয়েছি আমি।’ মতিনকে যখন আর্জেন্টিনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ই-মেইলে যোগাযোগ করে ঢাকায় আসতে বলা হয়, তখন তাঁর গ্রামের সবাই ধরেই নিয়েছে আর্জেন্টিনায় নিয়ে যাওয়া হবে তাঁকে। দাগনভূঞা প্রতিনিধি জানান, সিন্দুরপুর ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামে চার ভাইবোনের মধ্যে মতিন দ্বিতীয়। এক কন্যাসন্তান, স্ত্রী আর মাকে নিয়েই তাঁর সংসার। পরিশ্রমী, কর্মঠ মতিনকে প্রতিবেশীরাও বেশ পছন্দ করেন। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মো. নূর নবী জানান, মতিনকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানানোয় গোটা ইউনিয়নের মানুষ আনন্দিত। লক্ষ্মীপুর গ্রামের মোল্লাবাড়ির ছেলেটিই এখন তাঁদের কাছে মেসি। তবে তাঁদের সেই মেসি মতিনের একটি আবেদনও রয়েছে। তাঁর অনুরোধ– ফুটবল উন্মাদনায় এমন কিছু যেন না হয়, যার রেশ টানতে হয় সারাজীবন।