মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিপীড়নের মুখে এবং বর্বর হত্যাযজ্ঞ থেকে প্রাণ বাঁচাতে ১৩ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। নির্মম এ বর্বরতায় হতবাক হয়ে গিয়েছিল বিশ্বমানবতা। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার পর ২০১৮ সাল থেকে ২৫ আগস্ট দিনটিকে রোহিঙ্গারা গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। ২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যানিটির চেয়ারম্যান মাস্টার মুহিবুল্লাহর নেতৃত্বে ক্যাম্পে প্রথম বড় ধরনের সমাবেশ হয়। প্রত্যাবাসনবিরোধী মিয়ানমারের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরসার সন্ত্রাসীরা পরবর্তী সময়ে তাকে হত্যা করে। গত বছরের ২৫ আগস্ট ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ১৩ থেকে ১৪টি স্থানে ‘হোপ ইজ হোম’ ক্যাম্পেইন পালন করে রোহিঙ্গারা। তারা মিয়ানমারে টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর কাছে বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি তুলে ধরে। দীর্ঘ ৮ বছরে একজন রোহিঙ্গাও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। উল্টো আরাকানে চলমান সাম্প্রতিক সংঘাতের জেরে রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে ক্যাম্পে ঠাঁই নিয়েছে আরও ৬০ থেকে ৭০ হাজার রোহিঙ্গা। এমন পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার চার দিনের সফরে ঢাকায় এসেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরে যাওয়ার আগে শুক্রবার দুপুরে ঢাকার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। বৈঠকে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে বসবাসরত ১৩ লাখ রোহিঙ্গার জন্য মানবিক সহায়তা হ্রাস নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছেন, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করতে তিনি রমজান মাসে বাংলাদেশে এসেছেন। পৃথিবীতে এতটা বৈষম্যের শিকার অন্য কোনো জনগোষ্ঠী তিনি দেখেননি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের ভুলতে বসেছে উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, মানবিক সহায়তা কমানো একটি অপরাধ। পশ্চিমা দেশগুলো এখন প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় দ্বিগুণ করছে; কিন্তু তখন আবার বিশ্বজুড়ে মানবিক সহায়তা সংকুচিত হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রতি জাতিসংঘ ‘অপরিসীম কৃতজ্ঞতা’ প্রকাশ করেছে। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের প্রতি অত্যন্ত উদারতা দেখিয়েছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী তার জন্য একটি বিশেষ বিষয়। তিনি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন এবং তাদের জন্য সহায়তা সংগ্রহকে অগ্রাধিকার দেবেন।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস শুক্রবার কক্সবাজারের উখিয়ায় শরণার্থী শিবিরে প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর সঙ্গে ইফতার করেছেন। এটিকে বলা হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম বড় ইফতার। আর এর মাধ্যমে নতুন করে আশায় বুক বাঁধছে শরণার্থীরা। প্রধান উপদেষ্টা ও জাতিসংঘ মহাসচিবের একসঙ্গে ক্যাম্পে আসার খবরে রোহিঙ্গাদের মধ্যে উচ্ছ্বাস বিরাজ করছে। দুজনের প্রচেষ্টায় মিয়ানমারে নিরাপদ প্রত্যাবাসনে একটি গতি পাবে বলে আশা করছে রোহিঙ্গা নেতারা। জাতিসংঘ মহাসচিব আগেও একবার রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন। তবে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের এটিই প্রথম সফর।
আমরা মনে করি, এ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই যে, রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যাতে যথা শিগগির নিরাপদে তাদের নিজ ভিটায় ফিরে যায়, তেমন উদ্যোগকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। নানা কূটনৈতিক জটিলতায় আটকে আছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখতে হবে। আমরা প্রত্যাবাসনের জন্য কূটনৈতিক উদ্যোগের বাস্তবায়ন দেখতে উন্মুখ।