বাংলাদেশ রেলওয়েতে বিগত ১৫ বছরে রোলিং স্টক (লোকোমোটিভ, কোচ, ওয়াগন, ক্রেন, লাগেজ ভ্যান, রিলিফ ট্রেন ও যন্ত্রাংশ) সংগ্রহে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। তদন্তে উঠে এসেছে, ছোট-বড় ২৭ প্রকল্পে খরচ করা ওই অর্থের বড় একটি অংশই লোপাট হয়েছে। এসব রোলিং স্টকের অধিকাংশই এখন কাজে লাগছে না। ডেমুর অস্তিত্বই নেই। লোকোমোটিভগুলোর (ইঞ্জিন) অর্ধেকের বেশি অকেজো, যেগুলো চলছে সেগুলোর কাঙ্ক্ষিত গতি নেই, মাঝপথে যাচ্ছে বসে। কাজে আসছে না লাগেজ ভ্যান; কোচগুলো নষ্টপ্রায়। ওয়াশিং প্ল্যান্ট পুরোপুরি অচল।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিম্নমানের সামগ্রী ও যথাযথ সমীক্ষা ছাড়াই এসব কেনাকাটার কারণে ইঞ্জিন-কোচ-লাগেজ ভ্যানগুলোর এ দুরবস্থা। দেশের আপামর খেটে খাওয়া মানুষের টাকা পানিতে পড়লেও ঠিকই ফুলেফেঁপে উঠেছেন মন্ত্রী, সচিব, প্রকল্প পরিচালক থেকে জড়িত প্রায় সবাই। লুটপাটের টাকা গেছে লন্ডন, আমেরিকা, কানাডায়। ‘সবকিছু’র নিয়ন্ত্রণ ছিল পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে, আর দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন ‘ছোট আপা’ (শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা)। আর প্রকল্পের অসিলায় পরিদর্শনের নামে বিদেশ সফরে গিয়ে বিলাসে মেতেছেন মন্ত্রী থেকে প্রকল্প পরিচালক-সবাই। প্রমোদভ্রমণে ছিলেন পরিবারের সদস্যরাও। ‘কালোবিড়াল’ খ্যাতিতেও কারও গায়ে লাগেনি কালিমা।
জুলাই বিপ্লবের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন বড় আপা-ছোট আপা। মাত্র একজন মন্ত্রী কারাগারে। বাকি মন্ত্রীরা লাপাত্তা। আর রেলওয়েতে তাদের দোসররা এখনো বহাল। শুধু তাই নয়, যেখানে তাদের ওপর শাস্তির খক্ষ পড়ার কথা, সেখানে বরং তারাই হয়ে উঠেছেন হর্তাকর্তা। সাবেক প্রকল্প পরিচালকদের (পিডি) অনেকে চলমান প্রকল্পে দাদাগিরি করছেন, অনেকেরই হয়েছে পদোন্নতি। পেয়েছেন আরও লোভনীয় পদ-পদবি। আর পুরো মন্ত্রণালয়ই যেন ফ্যাসিস্টদের দোসরে ঠাসা।
সূত্র জানায়, সেই ১৫ বছরে রেলে প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। অধিকাংশ প্রকল্পই নেওয়া হয় ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার নির্দেশে। কয়েকটিতে কোনো সমীক্ষাই করা হয়নি। কাজের ক্ষেত্রে ‘বিশেষজ্ঞ’ নির্ধারিত হতো রাজনৈতিক পরিচয়ে। প্রকল্প, সফর আর ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রিত হতো রেলপথমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২১ সালে কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম থেকে দুই পর্বে ৩০টি লোকোমোটিভ কেনা হয়। এক্ষেত্রে ভয়াবহ দুর্নীতির প্রমাণ পায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রায় ১২শ কোটি টাকায় কেনা লোকোমোটিভগুলোর লাইফটাইম ২০ বছর ধরা হলেও বছর না যেতেই ১১টি ডিজেল শপে (মেরামতের জন্য) যায়। ৫টি মেরামত করা হচ্ছে। বাকিগুলোর কাজ শুরুর দিন-তারিখ ঠিক হয়নি। আবার যে ১৯টি লোকোমোটিভ চলছে, সেগুলোও মাঝেমধ্যেই বসে যাচ্ছে। এসব লোকোমোটিভ সব সেকশনে (রুটে) চালানোও যায় না। ৩২শ হর্স পাওয়ারের স্থলে লোকোমোটিভ আসে ২২শ হর্স পাওয়ারের।
সূত্র জানায়, এ ৩০ লোকোমোটিভ কেনায় যুক্ত ছিলেন তৎকালীন মন্ত্রী, রেলওয়ের মহাপরিচালক (ডিজি) সামসুজ্জামান ও এডিজি (আরএস) মঞ্জুর-উর-আলম চৌধুরী। রেলওয়েতে ‘ভ্রাম্যমাণ বঙ্গবন্ধু জাদুঘর’ (বর্তমানে এর অস্তিত্ব নেই) তৈরির কারণে সব অপরাধ থেকে মাফ পান মঞ্জুর-উর-আলম। সামসুজ্জামান ও মঞ্জুর-দুজনই ছিলেন সাবেক রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের প্রিয়ভাজন। এ প্রকল্পে পরিদর্শনের নামে আমেরিকায় গিয়েছিলেন-সুজন ও তার স্ত্রী, সামসুজ্জামান, মঞ্জুর-উর-আলম, পিডি হাসান মনসুরসহ ৯ জন। এ প্রকল্পে ৩০০ কোটি টাকার বেশি লুটপাটের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক। বর্তমানে নুরুল ইসলাম সুজন কারাগারে। তার বিরুদ্ধে অত্যাধুনিক রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণে ১৪২ কোটি টাকা সরকারি অর্থ আত্মসাৎসহ প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির অনুসন্ধান চলছে। আরও ৪ রেলপথমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, মুজিবুল হক ও জিল্লুল হাকিমের বিরুদ্ধে দুদক অবৈধভাবে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা অর্জনের অনুসন্ধান করছে।
প্রকল্পটির সাবেক পিডি নূর মোহাম্মদ জানান, তিনিই এ প্রকল্পের সর্বশেষ পিডি ছিলেন। ত্রুটিপূর্ণ ইঞ্জিনগুলো যখন তিনি গ্রহণ করছিলেন না-তখন তৎকালীন রেলপথমন্ত্রী, সচিব, ডিজি, এডিজি (আরএস) তার ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। একপর্যায়ে তাকে পিডি থেকে সরিয়ে ওই প্রকল্পের প্রথম পিডি হাসান মনসুরকে পুনরায় পিডি নিয়োগ দিয়ে ত্রুটিপূর্ণ ইঞ্জিনগুলো গ্রহণ করায়।
সূত্র আরও জানায়, ২০১৬ সালে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে প্রায় ৬৭৮ কোটি টাকায় ১৫০টি মিটারগেজ কোচ কেনা হয়। গড়ে প্রতিটির মূল্য ৪ কোটি ৫২ লাখ টাকা (যেখানে ভারতে মূল্য কোটি টাকার নিচে)। দুদকের অনুসন্ধানে ওই প্রকল্পে ২৫০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রমাণ পাওয়া যায়। দুদকের তদন্তে ওই সময়ের ডিজি সামসুজ্জামানসহ কয়েকজন কর্মকর্তার নাম আসে। তবে ‘আওয়ামীপন্থি’ কর্মকর্তা হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
সূত্রমতে, ১৫ বছরে ৭৪টি লোকোমোটিভ, ২০ সেট ডেমু, ৩০০টি মিটারগেজ ও ২২০টি ব্রডগেজ যাত্রীবাহী কোচ, ১৬৫টি ব্রডগেজ ও ৮১টি মিটারগেজ ট্যাংক ওয়াগন এবং ২৭০টি মিটারগেজ কনটেইনার ওয়াগন, ২৫০টি লাগেজ ভ্যান, ৪টি রিলিফ ক্রেন এবং ২টি ওয়াশিং প্ল্যান্ট সংগ্রহ করা হয়।
সূত্র জানায়, প্রায় ৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে একেকটি ইঞ্জিন ও ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে এক একটি যাত্রীবাহী কোচ কেনার সময় প্রচার চালানো হয়-১২০ থেকে ১৪০ কিলোমিটার গতি নিয়ে চলবে এসব। কিন্তু অধিকাংশের অবস্থা যে তথৈবচ। যেগুলো রেলপথে চলছে তার গড় গতি ৬০-৭০ কিমি.। অথচ ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে কেনা লোকোমোটিভ এখনো রেলপথ কাঁপিয়ে চলছে।
সমীক্ষা ছাড়া চীন থেকে ১২৫টি লাগেজভ্যান (২৮টি এসি) সংগ্রহ করে রেল। ২০২২ সালের আগস্টে তৎকালীন রেলপথমন্ত্রী, রেলপথ সচিব ও ডিজি শামসুজ্জামানের উপস্থিতিতে চুক্তিতে সই করেন প্রকল্প পরিচালক মিজানুর রহমান। ওই সময় এক কর্মকর্তার কাছে জানতে চেয়েছিল-‘এসব ভ্যান কীভাবে চালানো হবে। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘সবই প্রধানমন্ত্রীর (শেখ হাসিনা) নির্দেশনা, আমরা শুধু পালন করছি’।
লাগেজ ভ্যান কিনতে পিডি মিজানুর রহমানসহ ১০ জন চীন গিয়েছিলেন। এ প্রকল্পের প্রথম পিডি ছিলেন আব্দুল মতিন চৌধুরী। পরে হারুন-অর-রশীদ, মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী, কাজী মো. সেলিম ও বোরহান উদ্দিন দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ পিডি মো. বোরহান উদ্দিন বলেন, ‘আমি এ প্রকল্পের ৬ষ্ট প্রকল্প পিডি। ২৮টি এসি ভ্যান চলছে না। বাকিগুলো চালাতে আমরা চেষ্টা করছি।’
সূত্র জানায়, ২০১১ সালে প্রায় ৬০০ কোটি টাকায় কেনা ডেমু’র এখন অস্থিত্বই নেই। ডেমু কেনার সঙ্গে সম্পৃক্ত কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ ছাড়া রোলিং স্টক কেনার বিভিন্ন প্রকল্পে সময় বাড়িয়ে প্রকৃত ব্যয় থেকে ২-৩ গুণ বেশি ব্যয় বাড়ানো হয়েছে।
প্রায় ৪০ কোটি টাকায় কেনা দুটি স্বয়ংক্রিয় ওয়াশিং প্ল্যান্ট পুরোপুরি অকেজো। তৎকালীন রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ফজলে করিম চৌধুরীর নেতৃত্বে প্ল্যান্টদুটি কেনা হয়। এই যন্ত্রের কার্যকারিতা দেখতে ২০১৯ সালে তিন কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। এরা হলেন রেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি রোলিং স্টক) সৈয়দ ফারুক আহমেদ, প্রকল্প পরিচালক ফকির মো. মহিউদ্দিন ও উপসচিব মাহাবুবুল হক। ২০২১ সালে প্ল্যাণ্টগুলো উদ্বোধন করা হয়। বছর না যেতেই বন্ধ। এগুলো কেনায় জড়িত কারও বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি রেল। সূত্র জানায়, ওয়াশিং প্ল্যান্ট কেনা হয় যুক্তরাষ্ট্রের এনএস করপোরেশন থেকে। বাংলাদেশে সহযোগী ঠিকাদার নেক্সট জেনারেশন গ্রাফিকস লিমিটেড। অভিযোগ রয়েছে, নেক্সট জেনারেশনের পেছনে ছিলেন ফজলে করিম চৌধুরী ও তার ছেলে ফারাজ করিম চৌধুরী।
পরিকল্পনা দপ্তর সূত্র বলছে, রোলিং স্টক কেনাকাটায় লুটপাট সহজ-এমন চিন্তায় পতিত আওয়ামী লীগ সরকার ২০২৩ সালের শেষের দিকে আরও ৮০টি মিটারগেজ ও ৩২টি ব্রডগেজ ইঞ্জিন, ৩৫০টি মিটারগেজ ও ১০০টি ব্রডগেজ যাত্রীবাহী কোচ, ৫৮০টি মিটারগেজ ও ৪২০টি ব্রডগেজ ওয়াগন, ৭৫টি মিটারগেজ ও ৫০টি ব্রডগেজ লাগেজভ্যান, ২১টি ইঞ্জিন সংগ্রহে ৫টি নতুন প্রকল্প প্রকল্প গ্রহণ করে। এসব প্রকল্পে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়। এসব প্রকল্প নিয়ে এখন জটিলতায় রয়েছে রেল।
রেলওয়ে মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. আফজাল হোসেন বলেন, ‘নিশ্চয় পরিকল্পনা অনুযায়ী রোলিং স্টকগুলো কিনলে এমনটা হতো না। রোলিং স্টকগুলো চালাতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। লাগেজ ভ্যানগুলো কি করে কাজে লাগিয়ে আয় বাড়ানো যায় এ নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করছি।’
রেল পরিবহণ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. সামছুল হক বলেন, রেলে কোনো প্রকল্পে সূদুরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল না। কেনাকাটায় অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ পদে পদেই রয়েছে। সমীক্ষার নামে জোচ্চুরি হয়েছে। ডেমু থেকে লাগেজ ভ্যান-সব প্রকল্পেই লুটপাট হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন ও প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন একনেক কীভাবে এসব প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছিল; কারা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত-সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনার এখনই সময়। দুর্নীতিবাজদের এখনই আইনের আওতায় আনতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলওয়ে উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, আওয়ামী সরকারের সময়ে রেলে উন্নয়নের পেছনে ছিল লুটপাট। সরকারপ্রধান, মন্ত্রী ও প্রকল্পে সম্পৃক্তদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণও মিলছে। দুদক অনুসন্ধানও করছে। রোলিং স্টক কেনায় দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত কেউ রেহাই পাবে না। মন্ত্রী আরও বলেন, তদন্ত রিপোর্টেও নানা গরমিল থাকছে। কেন যথাযথ পণ্য কেনা হয়নি, কেন ইঞ্জিন-কোচ-ওয়াগন অকেজো হয়ে পড়ছে-এজন্য সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহি করতে হবে। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।