শিল্প খাতের জন্য বরাদ্দকৃত গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদনের জন্য দেওয়া হচ্ছে। এতে তীব্র গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে শিল্প কল-কারখানায়। গ্যাস না থাকায় কারখানাগুলোর উৎপাদনে ধস নেমেছে। গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল মিলগুলোর উৎপাদন ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। অনেক কারখানা বন্ধ হওয়ার পথে।
দেশের একটি বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়ে এই উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকেও গ্যাস সংকটের বিষয়ে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। গ্যাসের অভাবে গত কয়েক দিনে প্রায় ৪০০ গ্যাসনির্ভর কারখানা, পূর্ণক্ষমতায় উৎপাদন করতে পারছে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, শিল্পের গ্যাস বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরবরাহ দেশের অর্থনীতির জন্য ভয়ংকর দুসংবাদ।
গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো জানিয়েছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাস সরবরাহে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে দেশের প্রধান শিল্পাঞ্চলগুলোতে।
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির উপ-মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী ফারুক জানান, দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পাঞ্চল গাজীপুরের কারখানাগুলোয় দৈনিক ৬০০ থেকে ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস (এমএমসিএফডি) প্রয়োজন হয়। সেখানে সরবরাহ সীমাবদ্ধ রয়েছে মাত্র ৪৫০ মিলিয়ন ঘনফুটে ।
তিনি বলেন, সরবরাহের চেয়ে চাহিদা অনেক বেশি হওয়ায় গ্যাসের চাপ কম থাকে। পেট্রোবাংলার তথ্যমতে, বর্তমানে দেশের মোট গ্যাস চাহিদা ৩,৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট, অথচ সরবরাহ মাত্র ২,৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট।
পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যানকে গত ২২ এপ্রিল দেওয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ হঠাৎ করে তিতাস নেটওয়ার্কের শিল্প কারখানাগুলোতে ১২০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। এই গ্যাস তারা বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদনের জন্য দিচ্ছে। এতে তিতাস নেটওয়ার্কে বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জ, ধামরাই, মানিকগঞ্জ, সাভার, কোনাবাড়ী, শফিপুর ও গাজীপুরের বেশির ভাগ রপ্তানিমুখী কারখানায় গ্যাসের চাপ শূন্যে নেমে গেছে। এতে তাদের উৎপাদন কার্যক্রম প্রায় অচল হয়ে পড়ছে। ফলে তারা ক্রেতার অর্ডার অনুযায়ী পণ্য রপ্তানি করতে পারছেন না। অতীতে এসব এলাকায় গ্যাসের চাপ কখনোই শূন্যে নামেনি।
সরেজমিন গাজীপুর, কোনাবাড়ী, শফিপুর এলাকা ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে গত কয়েক দিনে প্রায় ৪০০ গ্যাসনির্ভর কারখানা, প্রধানত বস্ত্র, সিরামিক ও স্টিল খাতে এখন পূর্ণক্ষমতার অনেক নিচে চলছে। অনেক উদ্যোক্তা জানান, ৭ থেকে ১৫ পিএসআইয়ের অনুমোদিত গ্যাস লোডের জন্য বিল দিয়েও ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন তারা। গ্যাস সংকট, বৈশ্বিক চাহিদার পতন ও উৎপাদন ব্যয়ের ঊর্ধ্বগতির কারণে দেশের অন্তত ২০টি টেক্সটাইল মিল বিক্রির প্রক্রিয়ায় রয়েছে বলে জানা গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সরকার চাইলে সার আমদানি করতে পারে। অন্য জ্বালানি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে। কিন্তু তা করছে না। উলটো শিল্পের গ্যাস কমিয়ে বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদনে দেওয়া হচ্ছে। এটা দেশে অর্থনীতির জন্য খুবই ভয়ংকর সংবাদ। তাদের প্রশ্ন অর্থনীতি ধ্বংস করে মানুষকে এয়ারকন্ডিশনে রেখে সরকার কি লোডশেডিং না করার বাহাবা নিতে চাচ্ছে?
শিল্পমালিকরা বলছেন, সময়মতো পণ্য রপ্তানি করতে না পারায় বাতিল হচ্ছে ক্রয়াদেশ। পণ্য না পেয়ে বিদেশি বায়াররা চলে যাচ্ছেন অন্য দেশে। সংশ্লিষ্টদের মতে, একটি কারখানার বয়লার চালানোর জন্য প্রতি ঘনফুটে ১৫ পিএসআই গ্যাসের চাপ দরকার হলেও সে চাপ কমে প্রতি ঘনফুটে এক থেকে দুই পিএসআইতে দাঁড়িয়েছে। কোথাও কোথাও শূন্যে নেমেছে। বাধ্য হয়ে উচ্চমূল্যের ডিজেলচালিত জেনারেটর ব্যবহার করে উৎপাদন কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে উৎপাদন খরচ। এভাবে চলতে থাকলে অনেক শিল্পকারখানা একেবারেই বন্ধ হয়ে যাওয়ার শঙ্কায় মালিকরা। শ্রমিকদের বেতন নিয়েও চলছে দুশ্চিন্তা।
গাজীপুরের পোশাক কারখানা সাদমা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নাসির উদ্দিন বলেন, রাতের শিফটে কাজ করে, বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থা করেও আমরা ৪০ শতাংশ উৎপাদন সক্ষমতা রক্ষা করতে পারছি না। আগে যেখানে দৈনিক ৬০ টন সুতা তৈরি হতো, এখন তা নেমে এসেছে ১০ টনে। এ অবস্থায় কারখানা কার্যক্রম চালু রাখতে তারা ব্যায়বহুল ডিজেল, এলপিজি ও সংকুচিত প্রাকৃতিক গ্যাস (সিএনজি)-এর মতো বিকল্প জ্বালানিতে ঝুঁকছে।
নোমান গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বলেন, গত ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহের চিত্র তুলে ধরে তিনি পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে জানিয়েছেন, ১০০ থেকে ১২০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস এখন শিল্পকারখানায় কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে তিতাস নেটওয়ার্কের বেশির ভাগ শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, গত দুই বছরে গ্যাসের দাম দুই দফায় বাড়ানোর পরেও গ্যাসের তীব্র সংকট চলছে। সরকার প্রথমে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের আশ্বাস দিয়ে ১৭৯ শতাংশ দাম বাড়ায়। এরপর ফের একই প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে আরও ৩৩ শতাংশ বাড়ানো হয়। কারখানা মালিকরা বলছেন, সব আশ্বাস সত্ত্বেও গ্যাস সরবরাহ আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে, উন্নতির কোনো লক্ষণ নেই।
গাজীপুরের স্প্যারো অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক শোভন ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের আপত্তি সত্ত্বেও সরকার গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে, কিন্তু সরবরাহ তো পাচ্ছি না। কোনো কোনো দিন মাত্র ২ ঘণ্টার মতো গ্যাস থাকে। গত সপ্তাহ থেকে পরিস্থিতি খুবই খারাপ হয়ে পড়েছে।
শিল্পমালিকরা বলছেন, এমনিতে তারা লোকসানে জর্জরিত। এভাবে চলতে থাকলে আর্থিক চাপের মধ্যে ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধ অসম্ভব হয়ে পড়বে। ফলে ব্যবসায়ীদের ঋণখেলাপি হওয়া, কর্মী ছাঁটাই ও ভয়াবহ শিল্পমন্দার ঝুঁকি বাড়বে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ১,৮৫৪টি টেক্সটাইল কারখানা রয়েছে, যেখানে মোট বিনিয়োগ প্রায় ২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে প্রায় ৯০০টি কারখানা গ্যাসনির্ভর, টেক্সটাইল শিল্প স্থাপনে বিপুল বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়। বিশেষ করে স্পিনিং মিলগুলোর ক্ষেত্রে যেখানে মূলধনের পরিমাণ ১০০ কোটি টাকা থেকে শুরু করে ১,০০০ কোটি টাকা পর্যন্ত হতে পারে। ফলে যেসব কারখানা মালিক বড় অঙ্কের ব্যাংক ঋণ করেছেন, তারা এখন এই আর্থিক দায় নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।
দেশের টেক্সটাইল খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, ২০২৩ সালের শুরুতে হঠাৎ করেই গ্যাসের দাম দ্বিগুণ হয়ে যায়। এর পরপরই নতুন মজুরি কাঠামো বাস্তবায়নের চাপ আসে। এসব মিলিয়ে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তাদের উৎপাদনের খরচ বেড়েছে বহুগুণ। সে তুলনায় তাদের পণ্যের বিক্রয়মূল্য যথাযথ হারে না বাড়ায় ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
ইসরাক স্পিনিং মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুল হক বলেন, আমরা এখন প্রায় ৪০ শতাংশ সক্ষমতায় উৎপাদন চালাচ্ছি। অথচ দৈনিক ১৮০ টন সুতা উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে আমাদের কারখানায়।
গাজীপুরের শিল্পাঞ্চলে প্রায় ২২ লাখ শ্রমিক কাজ করছেন। গত ১ মাস ধরে এ এলাকার শিল্পমালিকদের চোখে ঘুম নেই। এ অবস্থায় তারা প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
তাদের দাবি, রপ্তানি বাজার ধরে রাখতে দ্রুত নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করতে হবে। শিল্পমালিকরা বলছেন, একদিকে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা (ডলার) মিলছে না, অন্যদিকে গ্যাসের এমন সংকট চলতে থাকলে এ খাতে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসবে।
কালিয়াকৈর উপজেলার শফিপুর যমুনা স্পিনিং ডিভিশনের এক জিএম (প্রশাসন ও মানবসম্পদ) বলেন, দিনভর কারখানায় গ্যাস থাকে না। কারখানার চার শিফটের মধ্যে এক শিফট কাজ চলে; বাকি তিন শিফট কাজ করানো যাচ্ছে না। ফলে উৎপাদন মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে কারখানার শ্রমিকদের বেতন দিতে কষ্ট হবে।
কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা এলাকার এক ব্যবসায়ী জানান, কারখানায় গ্যাসের চাপ ২-৩ পিএসআই বেশি উঠে না। বাধ্য হয়ে ডিজেলের জেনারেটর চালাতে হয়। এভাবে ডিজেল ব্যবহার করলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। তখন লোকসান গুনতে হবে।
সংকট সমাধানের তাৎক্ষণিক কোনো সম্ভাবনা নেই
পেট্রোবাংলার পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, আগে বিদ্যুৎ খাতে বরাদ্দ ছিল ১,০৫০ এমএমসিএফডি। শীতে চাহিদা কম থাকায় সরবরাহেরও প্রয়োজন কমে যায়। কিন্তু এখন গ্রীষ্মে চাহিদা বেড়েছে। ফলে ঘাটতি প্রকট হয়েছে।
তিনি বলেন, গ্যাসের স্থানীয় উৎপাদন না বাড়ানো পর্যন্ত এই সংকট সহজে কাটবে না। তবে মাসের শেষ নাগাদ দেশীয় উৎস থেকে ২৮ এমএমসিএফডি গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হতে পারে এবং মে মাসে আরও কিছু পরিমাণ গ্যাস যোগ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।