বৈদেশিক ঋণে প্রাধান্য চীনের এনডিবি

প্রকাশিতঃ মে ৬, ২০২৫ | ৯:০৭ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেক্স

বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে দাতা সংস্থা আইএমএফ-এর প্রাধান্য কমলেও অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকারে উঠে আসছে চীনের নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি)। সংস্থাটি বছরে একশ কোটি মার্কিন (১ বিলিয়ন) ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ইতোমধ্যে তিন প্রকল্পের জন্য ৯৫ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছে বাংলাদেশ, যা অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। যদিও এনডিবির ঋণ হচ্ছে বাজারভিত্তিক, অর্থাৎ উচ্চ সুদহার ও অনমনীয় (কঠিন শর্ত)। তবে ঋণের শর্ত সহজ এবং সুদহার নমনীয় পর্যায়ে আনতে সম্প্রতি এনডিবির ভাইস প্রেসিডেন্ট মি. ভ্লাদিমির কাজবেকভকে অনুরোধ করেছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সব শর্ত মেনে ঋণ নিতে নারাজ-এমন কথা বুধবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা। এ মন্তব্যের একদিন আগে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ-এর বসন্তকালীন বৈঠকে অংশগ্রহণ শেষে দেশে ফিরেন। সেখানে সাইডলাইনে আইএমএফ-এর প্রতিনিধির সঙ্গেও বৈঠক করা হলেও ঋণের কিস্তির বিষয়ে কোনো ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। অর্থ উপদেষ্টা আরও বলেছেন, সংস্থাটির (আইএমএফ) ঋণ কর্মসূচি বজায় রাখা নিয়ে একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নেবে অন্তর্বর্তী সরকার। এতে আইএমএফ চলমান ঋণের কিস্তি দিলে দেবে, না দিলে নিজেদের মতো করে বাজেট করব। প্রকল্প সহায়তার জন্য বিশ্বব্যাংক, এডিবি পাইপলাইনে আছে। এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) থেকে এক মিলিয়ন ডলার চেয়েছি। এনডিবি ও ইসলামি ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে সহায়তা চেয়েছি। বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্থ উপদেষ্টার এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রাধান্য কমে যাচ্ছে আইএমএফ-এর। যদিও বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ অনুমোদন করে তিনটি কিস্তি ছাড় করেছে সংস্থাটি। এরপর আইএমএফ-এর ঋণের শর্ত পূরণ না হওয়ায় সংস্থাটি চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি ছাড় করেনি। এদিকে এনডিবি থেকে ঋণ নিতে নানা পদক্ষেপ শুরু করেছে সরকার। বাংলাদেশে উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ২০২৫ সালের মধ্যে এনডিবি ১০০ কোটি (১ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার এবং পরবর্তী পাঁচ বছরে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে। ওই কর্মসূচির আওতায় এনডিবির কাছে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ৯৫ কোটি ডলার চাওয়া হয়েছে। এই ঋণের মধ্যে ৩২ কোটি ডলার ব্যয় হবে ঢাকা শহরের পানি সরবরাহ সম্প্রসারণ প্রকল্প বাস্তবায়নে। এছাড়া ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ গ্যাস অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প ২৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার এবং তিতাস গ্যাসের সরবরাহ ও সক্ষমতা উন্নয়ন প্রকল্প ব্যয় হবে ২৫ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। সূত্রমতে, আগামী দিনে এনডিবির ঋণে বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ বেশকিছু লাভজনক প্রকল্প শনাক্ত করেছে। এর মধ্যে রয়েছে-‘ইস্টার্ন রিফাইনারি লি.’-এর অবকাঠামো উন্নয়ন, ভোলা-বরিশাল-খুলনা ২৫০ কিমি. গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প, পটুয়াখালী ১০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র, পদ্মা ৮০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, পদ্মা ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (দ্বিতীয় পর্যায়) প্রকল্প এবং রাজধানীর মিরপুরে সুয়ারেজ লাইন স্থাপন প্রকল্প। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, এনডিবি থেকে ঋণ নিতে নানা বিষয় পর্যালোচনা করতে এ পর্যন্ত একাধিক বৈঠক হয়েছে। তবে সেখানে উঠে আসে এনডিবি ঋণের উচ্চ সুদহার এবং অনেক ক্ষেত্রে এ ঋণ অনমনীয়। যদিও প্রকল্প প্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রে অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম সময় নিয়ে থাকে। এছাড়া সবকিছু সঠিক থাকলে সাধারণত ৮ থেকে ১০ মাসের মধ্যে ঋণ পাওয়া সম্ভব। এছাড়া মাল্টিকারেন্সিতে (বিভিন্ন বৈদেশিক মুদ্রায়) ঋণের অর্থ দেওয়া হয়। সর্বশেষ ইআরডির অতিরিক্ত সচিব মিরানা মাহরুখের সভাপতিত্বে এনডিবি থেকে ঋণ নেওয়া সংক্রান্ত বিষয়ে একটি বৈঠক হয়। সেখানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় তাদের অর্থের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। তবে এনডিবির অর্থায়ন নিয়ে কিছুটা শঙ্কা প্রকাশ করে ওই বৈঠকে মিরানা মাহরুখ বলেছেন, সরকারের অগ্রাধিকার বিবেচনায় এবং আগামী দিনে কোনো দায় যেন সৃষ্টি না হয়, সেদিকে লক্ষ রেখে প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। ওই বৈঠকে বলা হয়, যেসব প্রকল্প আর্থিকভাবে লাভজনক, সরকারের জন্য দায় সৃষ্টি হবে না, বাস্তবায়নকারী সংস্থার সঙ্গে সরকারের সাবসিডিয়ারি ঋণচুক্তি হবে এবং জমি অধিগ্রহণসহ আনুষঙ্গিক কাজ শেষ হয়েছে, সেক্ষেত্রে এই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বাস্তবায়ন করা সমীচীন। এনডিবির ঋণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইআরডির এক কর্মকর্তা জানান, ঋণ গ্রহণকারী দেশের ক্রয় এবং পরিবেশসংক্রান্ত আইন অনুযায়ী প্রকল্পের কার্যক্রম গ্রহণ করতে উৎসাহিত করে এনডিবি। যে কারণে ঋণ গ্রহণকারী দেশের প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় খরচ কম হয়। অ্যাডভান্স প্রকিউরমেন্টের বিধান থাকায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হলে কমিটমেন্ট ফি মওকুফ পাওয়া যায়। সূত্রমতে, এনডিবি থেকে ঋণ নিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় তাদের প্রকল্পের তালিকা প্রস্তুত করছে। বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, তিনটি প্রকল্প বিবেচনার জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। এসব প্রকল্প নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ সরবরাহ নিশ্চিত করবে। এছাড়া আশুগঞ্জ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের পক্ষে সংশ্লিষ্ট তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ‘রায়পুরা ১২০ এমডব্লিউপি (এসি) গ্রিডটাইড সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট’ প্রকল্প বিবেচনার জন্য অনুরোধ করেছেন। এদিকে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য এনডিবির ঋণ বিবেচনায় আনা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার মতে, ‘কনস্ট্রাকশন অব ভোলা-বরিশাল-খুলনা গ্যাস ট্রান্সমিশন পাইপলাইন’ এবং ‘মর্ডানাইজেশন অ্যান্ড এক্সপেনশন অব ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড’ প্রকল্প দুটি বিবেচনার জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ‘মর্ডানাইজেশন অ্যান্ড এক্সপেনশন অব ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড’ প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত। রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, এনডিবিতে অ্যাডভান্স প্রকিউরমেন্ট, মালটি কারেন্সি ঋণ নেওয়ার সুবিধা থাকায় দুটি প্রকল্প বিবেচনার জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে ‘মর্ডানাইজেশন অব সেন্ট্রাল লোকোমোটিভ ওয়ার্কশপ (সিএলডব্লিউ)’ এবং ‘মর্ডানাইজেশন অব সৈয়দপুর ওয়ার্কশপ’ শীর্ষক প্রকল্প। দুটির ফিজিবিলিটি স্টাডি প্রায় সম্পূর্ণ হয়েছে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ টেলিটকের আওতাধীন তিনটি প্রকল্প বিবেচনার জন্য পাঠানো হয়। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হলে তাদের প্রতিষ্ঠানের জন্য সুবিধা হবে। তবে প্রকল্পগুলোর এখনো সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা হয়নি। এনিডিবির ভাইস প্রেসিডেন্টের সঙ্গে অর্থ উপদেষ্টার বৈঠক : ৮ এপ্রিল ঢাকায় সফরকালে অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেছেন নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এনডিবি) ভাইস প্রেসিডেন্ট মি. ভ্লাদিমির কাজবেকভ। অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ওই বৈঠকে বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের উন্নয়নে এনডিবির আগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন অর্থ উপদেষ্টা। তিনি ২০২৬ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উত্তরণের প্রক্রিয়ায় এনডিবিকে সহনীয় অর্থায়ন প্রদানকারী একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হওয়ার আহ্বান জানান। অর্থ উপদেষ্টা আরও বলেন, বাংলাদেশকে অতিরিক্ত অর্থায়নের প্রয়োজন রয়েছে। তবে এনডিবির অর্থায়ন ব্যয়বহুল হওয়ায় তা বাংলাদেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এজন্য ঋণের শর্তাবলি ও নিয়মাবলি পুনর্বিবেচনা করার অনুরোধ করেন। এছাড়া এনডিবির একটি আবাসিক অফিস স্থাপনের অনুরোধ করেছেন। যাতে প্রকল্পগুলোর সমন্বয়, তদারকি ও নজরদারি আরও কার্যকর হয়। এনডিবি : ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা-এই পাঁচটি দেশের উদ্যোগে গঠিত ব্রিকস একটি মাইলফলক অর্জন হলো চীনের নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি) প্রতিষ্ঠায়। বাংলাদেশ মোট ১৮ কোটি ৮৪ লাখ মার্কিন ডলারের শেয়ার কিনেছে। এতে বাংলাদেশের মালিকানার অংশ ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ। এর মধ্যে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ৬৫ কোটি ৯৪ লাখ মার্কিন ডলার পরিশোধ করেছে। এ ব্যাংকের অনুমোদিত প্রাথমিক মূলধন ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এটি এক লাখ ডলারের এক মিলিয়ন শেয়ারে বিভক্ত। প্রাথমিক পাঁচ সদস্য দেশ মোট ৫০ বিলিয়ন ডলারের ৫ লাখ শেয়ার সাবস্ক্রাইব করেছে, যার মধ্যে ১০ বিলিয়ন ডলার পেইড-ইন এবং ৪০ বিলিয়ন ডলার কলেবল ক্যাপিটাল।