আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত বাস্তবায়নের ফলে নিম্নমুখী মূল্যস্ফীতির হারে ফের চাপ বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। শর্ত অনুযায়ী ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে ডলারের দাম বেড়ে যাবে, কমবে টাকার মান। মূল্যস্ফীতির হার সন্তোষজনক পর্যায়ে নেমে না আসা পর্যন্ত সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করতে হবে। এতে ঋণের সুদের হার বাড়বে, কমবে টাকার প্রবাহ। ফলে একদিকে বেসরকারি খাতে ঋণের জোগানও কমবে, অন্যদিকে ব্যবসা খরচ বাড়বে। এর প্রভাবে বাড়বে পণ্যের দাম। বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমাতে হলে দাম বাড়াতে হবে। ফলে সব পণ্য ও সেবার মূল্য বাড়বে। এসব কারণে মূল্যস্ফীতির হার আবার উসকে যেতে পারে।
এদিকে আইএমএফ বলেছে, এসব পদক্ষেপের ফলে দেশের অর্থনীতিতে টেকসই প্রবৃদ্ধি হবে। ডলারের দাম বাজার নিয়ন্ত্রণ করলে এর প্রবাহ বেড়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়বে। রাজস্ব আয় বাড়লে সরকারের বিনিয়োগ বাড়বে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, ডলারের ওপর কড়া নজর রাখা হবে। যাতে কোনো ব্যাংক কারসাজি করে দাম বেশি বাড়াতে না পারে। কোনো ব্যাংক সংকটে পড়লে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলারের জোগান দেওয়া হবে। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধির কারণে ডলারের দাম বেশি বাড়বে না বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
গত বুধ ও বৃহস্পতিবার বাজারভিত্তিক বিনিময় হারে ডলার লেনদেন হয়েছে। এতে ডলারের দাম খুব বেশি বাড়েনি। তবে কিছু ব্যাংক ১২২ টাকা করে রেমিট্যান্স কিনে ১২৩ টাকায় বিক্রি করেছে। বেশির ভাগ ব্যাংকেই ডলারের দাম ১২২ টাকার মধ্যেই আছে। তবে আগাম বেচাকেনার ক্ষেত্রে দাম বেড়েছে।
বৈশ্বিক মন্দার কারণে ২০২২ সালের মার্চ থেকে দেশে মূল্যস্ফীতির হার বাড়তে থাকে। ওই বছরের আগস্টে তা বেড়ে ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। গত বছরের জুলাই পর্যন্ত তা বেড়ে সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে ওঠে। ওই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বর্তমান সরকার দায়িত্ব নিয়ে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়ায় এ হার এখন কমছে। গত এপ্রিলে ৯ দশমিক ১৭ শতাংশে নেমে এসেছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি নেমেছে ৮ শতাংশের ঘরে। মূল্যস্ফীতির হার কমাতে সরকার কঠোর মুদ্রানীতি অনুসরণ, ডলার বাজার স্থিতিশীল রাখা, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছেড়ে সরকারকে ঋণের জোগান বন্ধ করা, পণ্যমূল্য কমানোর পদক্ষেপ নেয়। ফলে মূল্যস্ফীতির হার কমতে শুরু করেছে। তবে কঠোর মুদ্রানীতির কারণে সুদের হার বৃদ্ধি ও বিনিয়োগ কম হওয়ায় বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থানের গতি কমে গেছে। এতে বেকারদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে।
আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার কারণে বাড়বে ডলারের দাম, কমবে টাকার মান। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমবে। বাড়বে পণ্যমূল্য। যা মূল্যস্ফীতিতে চাপ সৃষ্টি করবে। মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত কঠোর মুদ্রানীতি অনুসরণ করতে হবে। এতে সুদের হার বাড়বে, টাকার প্রবাহ কমবে। ফলে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। এমনিতেই এখন বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ তলনিতে রয়েছে। বিদ্যমান অস্থিরতা, সুদের হার বেশি ও ব্যাংকে তারল্য সংকটে বেসরকারি খাত ঋণ পাচ্ছে না। ফলে কর্মসংস্থান সংকুচিত হচ্ছে। এতে ভোক্তার আয় বাড়বে না। কিন্তু ব্যবসা খরচ বাড়ার কারণে পণ্যমূল্য বাড়বে। এতে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ সৃষ্টি হবে।
আইএমএফ সরকারের ব্যয় নিয়ন্ত্রণের শর্ত দিয়েছে। ফলে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে খরচ কমবে। এতে কষ্ট বাড়বে স্বল্প আয়ের মানুষের। যা তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দেবে।
বিদ্যুৎ খাতে ব্যয় কমানো আইএমএফের অন্যতম একটি শর্ত। এটি বাস্তবায়ন করতে হলে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে। এর দাম বাড়লে সব খাতের পণ্য ও সেবার দামও বাড়বে। যা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
এছাড়া আইএমএফ অনেকগুলো ভালো পরামর্শ দিয়েছে। যেগুলো বাস্তবায়ন হলে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এর মধ্যে ব্যাংক খাতকে সবল করার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা ইত্যাদি।