চরম ক্ষতির মুখে ব্যবসায়ীরা আমদানি-রপ্তানি বাধাগ্রস্ত

প্রকাশিতঃ মে ২০, ২০২৫ | ৬:৩২ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেক্স

এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের কলমবিরতির ফলে আমদানি-রপ্তনি কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। পাঁচদিনের কর্মসূচিতে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা। রপ্তানিসহ কিছু বিষয় কলমবিরতির বাইরে রাখা হলেও বাস্তবে তা সেভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে না। কর্মকর্তারা নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য কর্মসূচি পালন করলেও ক্ষতি হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। এ অবস্থায় ব্যবসায়ী সংগঠনের কয়েকজন দায়িত্বশীল নেতা আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডার কর্মকর্তাদের সঙ্গে দ্রুত বৈঠকে বসে তাদের ন্যায্য দাবি মেনে নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এদিকে আজ বিকালে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের বৈঠক হতে যাচ্ছে। এজন্য কলমবিরতি কর্মসূচি সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে। বৈঠকে দুই ক্যাডারের ১২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী অংশ নেবেন বলে জানা গেছে। ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান বলেন, ‘রাজস্ব খাত অর্থনীতির বড় চালিকাশক্তি। সেখানে কলমবিরতির মতো কর্মসূচি কাম্য নয়। দাবি আদায়ে দেশের অর্থনীতিকে জিম্মি করার পরিবর্তে কাস্টমস ও আয়কর আদায়ে জড়িতরা সরকারের সঙ্গে বসে আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ সমাধান করতে পারে। বর্তমান সরকারের যৌক্তিক দাবি মেনে নেওয়ার মানসিকতা আছে বলে আমি মনে করি।’ তিনি আরও বলেন, ‘অর্থনীতি সচল রাখতে রাজস্ব খাতে কর্মরতদের সমস্যা বা দাবিগুলো সরকারের মনোযোগ দিয়ে শোনা উচিত এবং যত দ্রুত সম্ভব এর সমাধান হওয়া দরকার। তা না হলে দেশ আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-এর সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আব্দুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, এনবিআর-এর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কলমবিরতিতে রপ্তানি খাতকে আওতামুক্ত রাখা হলেও পরোক্ষভাবে রপ্তানি খাতে এর প্রভাব পড়ছে। আমদানিকৃত কাঁচামাল খালাসে বিলম্ব হচ্ছে বিধায় একদিকে উৎপাদন খরচ বাড়ার শঙ্কা রয়েছে, অন্যদিকে রপ্তানির লিড টাইম বেড়ে যাবে। এ কারণে রপ্তানি খাতে ইমেজ সংকটও দেখা দিতে পারে। তিনি আরও বলেন, সরকারের উচিত এনবিআর-এর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সংকটের দ্রুত সমাধান করা। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মে মাসে ৩৫ হাজার ১ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। সে হিসাবে দৈনিক রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। চলতি বছরের মে মাসে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি না হলে দৈনিক ওই পরিমাণ রাজস্ব আদায় হওয়ার কথা। কিন্তু আদায় না হওয়ায় দৈনিক রাজস্ব ক্ষতি আনুমানিক ১ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। এ হিসাবে ৫ দিনে মোট রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ৫ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা। গত বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি ৭-৮ শতাংশ হলে ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, টানা ৫ দিনের কলমবিরতির কারণে কাস্টম হাউজগুলোয় আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম প্রায় বন্ধ। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৭ হাজার বিল অব এন্ট্রি ও বিল অব এক্সপোর্ট দাখিল হয়। এর মধ্যে আমদানির ৫ হাজার ও রপ্তানির ২ হাজার ডকুমেন্ট জমা পড়ে। বিপরীতে শুল্কায়ন শেষে আমদানি কনটেইনার খালাস এবং যাবতীয় প্রক্রিয়া শেষে রপ্তানি কনটেইনার জাহাজীকরণ হয়ে থাকে। কিন্তু কলমবিরতির কারণে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ডকুমেন্ট দাখিলের হার নেমে এসেছে প্রায় অর্ধেকে। চট্টগ্রাম বন্দরে কমেছে পণ্য ডেলিভারিও। চট্টগ্রাম কাস্টমস অ্যান্ড ক্লিয়ারিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের (সিঅ্যান্ডএফ) কাস্টমসবিষয়ক সম্পাদক এএসএম রেজাউল করিম স্বপন সোমবার বলেন, কলমবিরতির কারণে কাস্টমসের স্বাভাবিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে। বিকাল তিনটা থেকে কার্যক্রম শুরু হলেও তখন হুড়োহুড়ি পড়ে যাচ্ছে। সকালে কাজ করতে না পেরে সিঅ্যান্ডএফ প্রতিনিধিদের অনেকেই ফিরে যাচ্ছেন। বিকালে তারা আর হাউজে আসছেন না। যদিও কাস্টমস কমিশনার কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছেন সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত থেকে ফাইলের কাজ শেষ করার জন্য।’ তিনি বলেন, ‘অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ না করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্তি করে তড়িঘড়ি গেজেট প্রকাশ করাটা একটা হঠকারী সিদ্ধান্ত বলে আমি মনে করি। এ সমস্যার দ্রুত সমাধান দরকার। না হয় দেশের অর্থনীতিতে ধস নামবে। এই ৫ দিনে এমনিতেই আমদানিকারকরা শত শত কোটি টাকা লোকসানের মুখে পড়েছে।’ চট্টগ্রাম বন্দর সচিব ওমর ফারুক বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতিদিন সাড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজার কনটেইনার ডেলিভারি হয়ে থাকে। কর্মবিরতির প্রভাব কিছুটা বন্দরে পড়ছে। গত কয়েকদিনে প্রতিদিন গড়ে তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার কনটেইনার ডেলিভারি হচ্ছে। তবে এসব ডেলিভারি আগের শুল্কায়নের বিপরীতে হচ্ছে। বর্তমানে যে কর্মবিরত চলছে, এর প্রভাব আরও কয়েকদিন পর প্রকট আকারে দেখা দিতে পারে। কলমবিরতি সাময়িক স্থগিত : সরকারের তরফ থেকে আলোচনার আশ্বাস পাওয়ায় কলমবিরতি কর্মসূচি সাময়িক স্থগিত করেছে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ। সোমবার বিকালে আগারগাঁও রাজস্ব ভবনে সংবাদ সম্মেলনে এ সিদ্ধান্তের কথা জানায় আন্দোলনকারীদের এ প্ল্যাটফর্ম। সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন কাস্টমসের উপকমিশনার ইমাম গাজ্জালী, শাহাদাত জামিল এবং আয়কর উপকর কমিশনার সাইফুর রহমান। সংবাদ সম্মেলনে ইমাম গাজ্জালী বলেন, এই আন্দোলনকে বিভিন্নভাবে ট্যাগিং দেওয়ার চেষ্টা চলছে। এ আন্দোলন পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসরদের সৃষ্টি- এমন গুজব ছড়ানোর অপচেষ্টাও আমরা দেখছি। এই আন্দোলনকে নস্যাৎ করার এমন বানোয়াট ও অসত্য প্রচারণা আপনারা বিগত কয়েকদিনে প্রত্যক্ষ করেছেন। আমরা দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলতে চাই, এ আন্দোলন সবার, সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর, এ আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্ত। এ ধরনের মিথ্যা ট্যাগিং দিয়ে বা গুজব ছড়িয়ে এই যৌক্তিক আন্দোলনকে নস্যাৎ করা যাবে না, বরং এই ধরনের মিথ্যাচার আন্দোলনকে আরও বেগবান করবে। যারা অসত্য ও বিকৃত তথ্য দিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলকে বিভ্রান্ত করছে, সময়ই বলে দেবে তাদের এই অপপ্রচার কীভাবে এই সমাজ ও রাষ্ট্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনার প্রস্তাব পেয়েছি। মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে ৩টায় আলোচনা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। অর্থ উপদেষ্টাসহ উপদেষ্টামণ্ডলীর কয়েকজন সদস্য এতে অংশগ্রহণ করবেন বলে আমরা আলোচনার অগ্রগতির ভিত্তিতে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করব।