পুরুষের প্রাণঘাতী প্রোস্টেট ক্যানসার: লক্ষণ ও চিকিৎসা পদ্ধতি

প্রকাশিতঃ মে ২৩, ২০২৫ | ৪:১৩ অপরাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেক্স

সম্প্রতি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ‘আগ্রাসী ধরনের’ প্রোস্টেট ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন। বাইডেনের অফিস এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ক্যানসারটি তার হাড়েও ছড়িয়ে পড়েছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ক্যানসারটির ‘গ্লিসন স্কোর ৯ (গ্রেড গ্রুপ ৫)’, যেখানে এটির সর্বোচ্চ স্কোর ১০। এর মানে হলো বাইডেনের ক্যানসারটি অত্যন্ত আক্রমণাত্মক। বাইডেন প্রোস্টেট ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে পুরুষদের এই নীরব ঘাতক রোগটি আবারও আলোচনায়। কী কারণে এ রোগ হয়, লক্ষণ কী কী এবং চিকিৎসা পদ্ধতি কী- তাই নিয়ে আজকের এই লেখা। প্রোস্টেট ক্যানসার কী? প্রোস্টেট হলো পুরুষদের মূত্রথলির কাছে অবস্থিত একটি ছোট গ্রন্থি, যা বীর্য তৈরিতে সহায়তা করে। আর পুরুষদের প্রোস্টেট গ্রন্থির ক্যানসারকেই প্রস্টেট ক্যানসার বলে। পুরুষদের মধ্যে এই ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার হার অনেক বেশি। সাধারণত ৫০ বছরের বেশি বয়স হলে পুরুষদের মধ্যে এই ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়তে থাকে। ওয়ার্ল্ড ক্যানসার রিসার্চ ফান্ড জানিয়েছে, বিশ্বব্যাপী এটি পুরুষদের মধ্যে দ্বিতীয় এবং সামগ্রিকভাবে চতুর্থ সর্বাধিক সাধারণ ক্যানসার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুরুষদের মধ্যে এটি সবচেয়ে বেশি নির্ণীত ক্যানসার। সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) জানিয়েছে, প্রতি ১০০ জন মার্কিন পুরুষের মধ্যে ১৩ জন এই রোগে আক্রান্ত হন। পুরুষদের প্রোস্টেট ক্যানসার কেন হয় এর সঠিক কারণ এখনো স্পষ্ট নয়। তবে উচ্চ চর্বিযুক্ত খাদ্য গ্রহণ এটির একটি কারণ হতে পারে বলে কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে। এছাড়াও প্রোস্টেট ক্যানসারের পারিবারিক ইতিহাস যদি থাকে তাহলে তাদের ঝুঁকি বেশি। বিশেষত নিকট আত্মীয়, রক্তের সম্পর্কের কারো যদি প্রোস্টেট ক্যানসার হয় তাহলে ঝুঁকি বেশি। যদি কারো পরিবারে ব্রেস্ট ক্যানসার হওয়ার ইতিহাস থাকে তাদের প্রোস্টেট ক্যানসার হওয়ারও ঝুঁকি বেশি থাকে। অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। গ্লিসন ইনডেক্স কী? প্রোস্টেট ক্যানসার নিশ্চিত করার জন্য বায়োপসি করা হয়। এতে আক্রান্ত স্থানের টিস্যু সংগ্রহ করে রোগের লক্ষণ পরীক্ষা করা হয়। গ্লিসন স্কোর বা গ্লিসন ইনডেক্স হলো একটি গ্রেডিং পদ্ধতি, যেখানে মাইক্রোস্কোপের নিচে ক্যানসার কোষের গঠন দেখে এটি কতটা আগ্রাসী তা নির্ধারণ করা হয়। একজন প্যাথলজিস্ট প্রোস্টেট টিস্যু পরীক্ষা করে দুটি গ্লিসন গ্রেড দেন। প্রতিটি গ্রেড ১ থেকে ৫ পর্যন্ত, যেখানে ১ মানে হলো স্বাভাবিক কোষের কাছাকাছি এবং ৫ মানে সবচেয়ে অস্বাভাবিক। এই দুটি গ্রেড যোগ করে গ্লিসন স্কোর নির্ধারণ করা হয়, যা ২ থেকে ১০ পর্যন্ত হয়ে থাকে। স্কোর ৯ বা ১০ মানে হলো খুবই আক্রমণাত্মক বা আগ্রাসী ধরনের ক্যানসার। প্রোস্টেট ক্যানসারের লক্ষণ কী কী? পুরুষের বয়স বৃদ্ধিকে প্রোস্টেট ক্যানসারের সবচেয়ে সাধারণ ঝুঁকির কারণ বলা হয়েছে। • এই ক্যানসার হওয়ার কিছু লক্ষণের মধ্যে রয়েছে: • ঘন ঘন প্রস্রাব করা • প্রস্রাব করতে অসুবিধা হওয়া • প্রস্রাবের সময় জ্বালাপোড়া • বীর্য বা প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত আসসা • হাড়ে ব্যথা অনুভূত হওয়া, প্রোস্টেট ক্যানসার হাড়ে ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বেশি। • ওজন কমে যাওয়া। • ইরেক্টাইল ডিসফাংশন বা যৌনশক্তি হ্রাস পাওয়া। প্রোস্টেট ক্যানসার সনাক্তের পদ্ধতি পুরুষের প্রোস্টেট ক্যানসার নির্ণয়ের জন্য অনেকগুলো পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে। রোগীর শারীরিক অবস্থা বা অন্যান্য লক্ষণগুলো পর্যবেক্ষণ করে চিকিৎসকরা রোগ নির্ণয়ের জন্য এর এক বা একাধিক পদ্ধতি ব্যবহার করেন। ১. প্রোস্টেট স্পেসিফিক এন্টিজেন টেস্ট (পিএসএ) এটি একটি রক্ত পরীক্ষা, যেখানে রক্তে পিএসএ নামক একটি প্রোটিনের মাত্রা পরিমাপ করা হয়। পিএসএ’র মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি হলে প্রোস্টেট ক্যান্সার, প্রোস্টেট ইনফেকশনের সম্ভাবনা থাকে। তবে পিএসএ উচ্চ হলে সবসময় ক্যান্সার বোঝায় না, তাই এটি একটি সূচকমাত্র। ২. ডিজিটাল রেক্টাল এক্সাম (ডিআরই) চিকিৎসক পায়ুপথ দিয়ে আঙ্গুল ঢুকিয়ে প্রোস্টেট গ্রন্থি স্পর্শ করে এর আকার, গঠন ও শক্ততা যাচাই করেন। যদি কোনো অস্বাভাবিকতা (চাকা, শক্ত অংশ ইত্যাদি) পাওয়া যায় তবে পরবর্তী পরীক্ষা করা হয়। ৩. প্রোস্টেট বায়োপসি প্রোস্টেট ক্যান্সার নির্ণয়ে এটি সবচেয়ে নির্ভযোগ্য পদ্ধতি। এই পদ্ধতিটি কয়েকটি ধাপে করা হয়। প্রথমে (আল্ট্রাসাউন্ড গাইডেন্স) রোগীর পায়ুপথে একটি বিশেষ আল্ট্রাসাউন্ড প্রোব ঢোকানো হয়, যা প্রোস্টেটের ছবি দেখাতে সাহায্য করে। এরপর ( নিডল ইনসারশন) এই ছবির ভিত্তিতে একটি বিশেষ সূঁচের মাধ্যমে প্রোস্টেটের বিভিন্ন অংশ থেকে ১০-১২টি ছোট টিস্যু নমুনা নেওয়া হয়। সবশেষে (টিস্যু বিশ্লেষণ) এই নমুনা মাইক্রোস্কোপের নিচে পরীক্ষা করে নিশ্চিতভাবে বোঝা যায় টিস্যুটি ক্যান্সার কোষে আক্রান্ত কি না। ৪. এমআরআই টিউমারটি কোথায় এবং কতটা বিস্তৃত তা বোঝার জন্য কখনো বায়োপসির আগে বা পরে এটি করা হয়। মূলত ক্যান্সার আক্রান্ত কোষটির উন্নত চিত্রায়নের জন্য এটি ব্যবহার করা হয়। ৫. সিটি স্ক্যান ও বোন স্ক্যান যদি সন্দেহ হয় ক্যান্সার শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়েছে (মেটাস্টেসিস), তাহলে সিটি স্ক্যান বা হাড়ের স্ক্যান করা হয়। এতে জানা যায় ক্যান্সার শরীরের অন্য কোথাও ছড়িয়েছে কিনা। চিকিৎসা পদ্ধতি প্রোস্টেট ক্যানসারের চিকিৎসা নির্ভর করে ক্যানসারের স্তর ও রোগীর শারীরিক অবস্থার ওপর: • সার্জারি (Prostatectomy): প্রোস্টেট গ্রন্থি অপসারণ • রেডিয়েশন থেরাপি: রেডিওথেরাপির মাধ্যমে ক্যানসার কোষ ধ্বংস • হরমোন থেরাপি: হরমোন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কোষের বৃদ্ধি থামানো • কেমোথেরাপি: ওষুধের মাধ্যমে ক্যানসার কোষ ধ্বংস • ইমিউন থেরাপি: শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো • অ্যান্ড্রোজেন ডিপ্রাইভেশন থেরাপি: শরীরে অ্যান্ড্রোজেনের মাত্রা কমিয়ে ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি বন্ধ করা। বাইডেনের চিকিৎসা কীভাবে হবে? বাইডেনের অফিস থেকে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘এই ক্যানসারটি হরমোন-সংবেদনশীল, যা কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।’ হরমোন-সংবেদনশীল প্রোস্টেট ক্যানসার বেড়ে উঠতে অ্যান্ড্রোজেন নামের পুরুষ যৌন হরমোনের ওপর নির্ভর করে। এই হরমোনের বেশিরভাগই উৎপন্ন হয় শুক্রাশয়ে। আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটি জানিয়েছে, এ ধরনের ক্যানসার অ্যান্ড্রোজেন ডিপ্রাইভেশন থেরাপি (Androgen Deprivation Therapy) দিয়ে চিকিৎসা করা যায়, যা শরীরে অ্যান্ড্রোজেনের মাত্রা কমিয়ে ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি বন্ধ করে দেয়। জনস হপকিন্স মেডিসিন জানিয়েছে, প্রোস্টেট ক্যানসার শনাক্ত হওয়ার পর সাধারণত ৫ বছরের বেঁচে থাকার হার প্রায় ১০০ শতাংশ। তবে ক্যানসার যদি শরীরের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে (যেমন বাইডেনের ক্ষেত্রে) তাহলে এই হার কমে ২৮ শতাংশে নেমে আসে। এছাড়া এই ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার পর ১০ এবং ১৫ বছর বেঁচে থাকার হার যথাক্রমে ৯৮ শতাংশ এবং ৯৫ শতাংশ। ম্যাসাচুসেটস জেনারেল ব্রিঘাম ক্যানসার সেন্টারের ম্যাথিউ স্মিথ জানিয়েছেন, গত কয়েক দশকে চিকিৎসার অগ্রগতি হয়েছে এবং মেটাস্ট্যাটিক প্রোস্টেট ক্যানসার রোগীরা গড়ে ৪ থেকে ৫ বছর বেঁচে থাকেন। তিনি অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে বলেছেন, ‘এটি খুবই চিকিৎসাযোগ্য, তবে পুরোপুরি সারানো সম্ভব নয়। বেশিরভাগ পুরুষ রোগী এই অবস্থায় ওষুধেই চিকিৎসা নেন এবং অস্ত্রোপচার বা রেডিয়েশন থেরাপি করার পরামর্শ দেওয়া হয় না।’ প্রতিরোধই সর্বোত্তম পন্থা, আগেই সতর্ক থাকুন বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের ওজন যাতে না বাড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস ও সুশৃঙ্খল জীবনাচার মেনে চলতে হবে। ভিটামিন ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ ফল, শাকসবজি এবং শস্য ও দানা জাতীয় খাবার খেতে হবে। নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর নিয়মিত চেকআপ করাতে হবে বিশেষ করে বয়স যদি ৫০ বছরের বেশি হয়। প্রোস্টেট ক্যানসার শনাক্ত হলে দেরি না করে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা শুরু করতে হবে। প্রোস্টেট ক্যানসার ধরা পড়লে ভয় না পেয়ে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। শুরুতেই ধরা পড়লে এটির নিরাময়ের সম্ভাবনা অনেক বেশি।